কোরবানির ঈদ এবং একজন আরজ আলী মাতুব্বরের অযাচিত মাতবরি
কোরবানির ঈদ এবং একজন আরজ আলী মাতুব্বরের অযাচিত মাতবরি
পদ্মার বুক চলে আমাদের লঞ্চ চলছে।
দুপাশ থেকে শুনতে পাচ্ছি পানির ছলাৎ ছলাৎ শব্দ। সাধারণত, লঞ্চগুলোর মাথার উপর বিশাল সাইজের একটি ছাউনি থাকে। কিন্তু আমাদের লঞ্চের উপরিভাগ খালি। কোন ছাউনি নেই।
আকাশটা একদম উদোম। তার ওপরে তারা-নক্ষত্র ভর্তি সুবিশাল আকাশ, নিচে আছে স্রোতস্বিনী পদ্মা।
চাঁদের প্রতিফলিত আলোতে নদীর পানি ঝিকমিক ঝিকমিক করছে। সে এক অদ্ভুত সুন্দর দৃশ্য !
আমরা যাচ্ছি রসুলপুর গ্রামে। বরিশাল জেলার মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলার প্রত্যন্ত একটি গ্রাম।
সাজিদের অনুরোধ, এবারের কোরবানির ঈদটা তার সাথে তাদের বাড়িতে করতে হবে। তাই যাওয়া।
তাছাড়া যখন শুনলাম, পদ্মা-মেঘনা সঙ্গমস্থলের উপর দিয়ে যাওয়া হবে, তখন আর লোভ সামলানো গেল না। আমি এর আগে কখনো এই দুই নদীকে স্বচক্ষে দেখিনি। তাই বিনা অজুহাতে তার প্রস্তাবে রাজি হয়ে গেলাম।
লঞ্চে আমরা তিনজন মাত্র মানুষ। আমি, সাজিদ এবং একজন চালক। মধ্যবয়স্ক এই লোকটার নাম মহব্বত আলী। যারা নৌকা চালায় তাদের মাঝি বলা হয়, যারা জাহাজ চালায় তাদের বলে নাবিক। যারা লঞ্চ চালায় তাদের কি বলে? আমি জানিনা। মহব্বত আলীর নামের এই লোক লঞ্চের এক মাথায় জড়সড় হয়ে বসে বসে ঝিমুচ্ছে। মাঝিদের মতো তার বৈঠা চালানোর চিন্তা নেই। তেলের ইঞ্জিন।
আমি আর সাজিদ মঞ্চের একেবারে মাঝখানে বসে আছি। একটি চাদর পাতা হয়েছে। সাথে আছে পানির বোতল, চিনা বাদাম, ভাজা মুড়ি।
মাথার উপরে আকাশ।
হঠাৎ করে আমার তখন মানিক বন্দোপাধ্যায়ের ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ উপন্যাসটির কথা মনে পড়ে গেল। আমি সাজিদ কে প্রশ্ন করলাম, -‘তুই কি মানিক দার ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ পড়েছিস?’
সাজিদ বলল, -‘হু’
আমিও কতবার পড়েছি এই উপন্যাস। সব চরিত্র গুলোর নাম আমার ঠিক মনে নেই। তবে উপন্যাসের নায়কের বউটা লেংড়া ছিল এবং নায়কের সাথে তার শালিকার প্রেম ছিল। এই ঘটনা গুলো আবছা আবছা মনে করতে পারি।
সাজিদ আমাকে বলল, -‘হঠাৎ উপন্যাসে চলে গেলি কেন?’
-‘না, এমনি।’
এইটুকু বলে দুজনে খানিকক্ষণ চুপচাপ ছিলাম। এরপর আমি জিজ্ঞেস করলাম, – ‘আচ্ছা ঐ উপন্যাসের কোন চরিত্রটি তোর কাছে সবচেয়ে ইন্টারেস্টিং লেগেছে?’
আমি ভাবলাম, সাজিদ হয় উপন্যাসের নায়ক কিংবা নায়কের শ্যালিকার কথাই বলবে। কিন্তু সাজিদ বলল, -‘ওই উপন্যাসে ইন্টারেস্টিং ক্যারেক্টার আছে কেবল একটাই। সেটি হল হোসেন মিয়া।’
আমি খানিকটা অবাক হলাম। অবাক হলাম কারণ সাজিদ এই প্রশ্নের উত্তর দিতে এক সেকেন্ডও ভাবেনি। আগে পড়া একটি উপন্যাস থেকে সে এমন একটি ক্যারেক্টার নাম বলছে যেটি উপন্যাসটির কোন মূল চরিত্রের মধ্যেই পড়ে না। হোসেন মিয়া নামে এই উপন্যাসে কোন চরিত্র আছে, সেটি আমি ভুলেই গিয়েছিলাম।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, -‘হোসেন মিয়া? নায়কটা নয় কেন?’
সাজিদ বলল, -‘কুবের মাঝির মতো কত কত শত মাঝি পদ্মা পারে অহরহ দেখা যায়, যাদের ঘরে মালার মতো একটি খোঁড়া পা ওয়ালা কিংবা অন্ধ স্ত্রী আছে, আছে তিন-চারটে করে পেটুক সন্তান, আছে কপিলার মত সুন্দরী শালীকা। তাদের মাঝেও পরকীয়া আছে, দৈহিক সম্পর্ক আছে। কিন্তু হোসেন মিয়া হোসেন মিয়ার মতো কোন চরিত্রে আছে এই পদ্মা পারে? যে কিনা নিজের মত করে একটি দ্বীপ সাজিয়ে তুলে সেখানে মানুষকে বিনা পয়সায় থাকতে দেয়। আছে?কি বাস্তবে, কি সাহিত্যে………’
আমি আরো একবার সাজিদের সাহিত্য জ্ঞান দেখে মুগ্ধ হলাম। সে এমনভাবে চরিত্রগুলোর নাম বলে গেল যেন, সে এইমাত্র উপন্যাসটি পড়ে শেষ করেছে।
আমরা রসুলপুরে পৌঁছাযই সাড়ে চারটেতে তখন কিছু কিছু জায়গার ফজরের আজান পড়েছে। যেখানে নেমেছি সেখান থেকে বেশ কিছু পথ হাঁটতে হবে।
খানিকটা হেঁটে একটা মাটির ঘরের সামনে এসে দাঁড়ালাম। বুঝতে পারলাম এটা মসজিদ। ভেতরে একটি কুপিবাতি মিটমিট করে জ্বলছে।
ব্যগপত্র রেখে দু’জন ওজু করে নিলাম। মসজিদে মানুষও আমরা তিনজন। আজব ! তিন সংখ্যাটা দেখি একদম পিছু ছাড়ছে না। লঞ্চেও ছিলাম আমরা তিনজন মসজিদে এসেও দেখি আমরা তিনজন।
নামাজ শেষ হয়েছে একটু আগে। আমরা বসে আছি মসজিদের বারান্দায়। একটু আলো ফুটলে বেরিয়ে পড়বো। ইমাম সাহেব আমাদের পাশে বসে কোরআন তেলাওয়াত করছেন। মাঝারি বয়স। দাড়িতে মেহেদি লাগিয়েছেন বলে দাড়িগুলো লালচে দেখাচ্ছে। উনি সূরা আর-রহমান তিলাওয়াত করছেন। ‘ফাবি আইয়্যি আলা-য়্যি রাব্বিকুমা তুকাজ্জিবান’ অংশ টিতে এসে খুব সুন্দর করে টান দিচ্ছেন। পরান জুরানিয়া।
আর রহমান তেলাওয়াত করে উনি কোরআন শরীফ বন্ধ করলেন। বন্ধ করে কোরআন শরীফের দুটি চুমু খেলেন। এরপর সেটাকে একবার কপালে আর একবার মুখে লাগিয়ে কি কাপড় দিয়ে পেঁচিয়ে একটা কাঠের তাকে তুলে রাখলেন।
আমরা লোকটার দিকে তাকিয়ে আছি। লোকটা আমার দিকে ফিরে বললেন, -‘আমনেরা কি শহর হইতে আইছেন?’
সাজিদ বলল, ‘জি।’
-‘আমনেরা কি লেখাপড়া করেন?’
সার্জিল আবার বলল, -‘জি।’
-‘মাশাল্লাহ মাশাল্লাহ। আমনেরা শহরের পইড়্যাও বিগড়াইয়া যান নাই। শুকুর আলহামদুলিল্লাহ।’
লোকটার কথা আমি ঠিক বুঝিনি। সাজিদ বুঝেছে। সে জিজ্ঞেস করল, -‘চাচা, শহরে পড়াশোনা করলে বিগড়িয়ে যায়, আপনাকে কে বলল?’
লোকটা হঠাৎ গম্ভীর মুখ করে বলল, -‘হেইয়া আবার কেডায় কইবে বাপ ! মোর ঘরেই তো জন্মাইছে একখান সাক্ষাৎ ইবলিশ।’
-‘কি রকম?’ সাজিদের প্রশ্ন।
-‘মোর এক্কুয়াই পোলা। পড়ালেখা করতে পাডাইলাম ঢাকা শহরে। হেইনে যাইয়া কি যে পড়ালেহা করছে ! এহন কয়, আল্লা-বিল্লা কইয়া বোলে কিস্যু নাই। এই যে, এহন তো বাড়িতে আইছে। আইয়া কইতেছে কি বোঝঝেন, কয় বলে কোরবানি দিয়া মোরা পশু হত্যা করি। এইগুলা বোলে ধর্মের নাম ভাইঙ্গা খাওনেন ধান্দা হরি মোরা। কিরপ্যিকা যে এইডারে ঢাকায় পড়তে পাডাইলাম বাপ ! হালুডি হরাইলে আজ এই দিন দেহা লাগতে না। !’
লোকটা সব কথা আমি বুঝতে পারিনি। তবে এইটুকু বুঝেছি যে, লোকটার ছেলে ঢাকায় পড়ালেখা করতে এসে নাস্তিক হয়ে গেছে।
সাজিদ বলল, -‘আপনার ছেলে এখন বাড়িতে আছে?’
-‘হ’
সাজিদ আমার দিকে ফিরে বললো, -‘দেখছিস, মেঘনার এত বড় বুকেও কিন্তু নাস্তিকদের বসবাস আছে। হা হা হা।
সিদ্ধান্ত হলো ছেলেটার সাথে দেখা করে যাব।
সকাল ন’টায় ছেলেটার সাথে আমরা দেখা হল। বয়সে আমাদের চেয়ে ছোট হবে। জিজ্ঞেস করে জানলাম, ছেলেটা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিষয় নিয়ে পড়ছে। ফার্স্ট ইয়ারে। নাম মোঃ রফিক।
সাজিদ রফিক নামের ছেলেটির কাছে জিজ্ঞেস করল, -‘কোরবানি নিয়ে তোমার প্রশ্ন কি?’
ছেলেটা বলল, -‘এইটা একটা কুপ্রথা। এভাবে পশু হত্যা করে উৎসব করার কোন মানে হয়?’
সাজিদ বলল, -‘তুমি কি বিজ্ঞান সম্পর্কে কিছু জানো?’
ছেলেটি চোখ বড় বড় করে বলল, -‘আপনি কি আমাকে বিজ্ঞান শিখেচ্ছেন নাকি? ইন্টারমিডিয়েট লেবেল পর্যন্ত আমি বিজ্ঞানের ছাত্র ছিলাম।’
-‘তা বেশ। খাদ্য শৃংখল সম্পর্কে নিশ্চয়ই জানো?’
-‘জানি। জানবো না কেন?’
-‘খাদ্য শৃংখল হলো, প্রকৃতিতে উদ্ভিদ ও প্রাণীর মধ্যকার একটি খাদ্য জাল। যেসব উদ্ভিদ সূর্যের আলো ব্যবহার করে নিজের খাদ্য নিজে তৈরি করে নেয় তাদের বলা হয় উৎপাদক। এই উৎপাদককে বা উদ্ভিদকে যারা খায়, তারা হচ্ছে প্রথম শ্রেণীর খাদক…..’
ছেলেটা বলল, -‘মশাই, এসব আমি জানি। আপনার আসল কথা বলুন।’
ছেলেটার কথার মধ্যে কোন রকম আঞ্চলিকতার টান নেই। তাই বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে না।
পাশ থেকে ছেলেটার বাবা বলে উঠলেন, -‘এ, হেরা বয়সে কোলাং তোর চাইয়া বড় অইবে। মান ইজ্জত দিয়া কথা কইতে পারো না?’
ছেলেটা তার বাবার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালো। সে দৃষ্টিতে পড়াশোনা জানা ছেলেদের মূর্খ বাবার প্রতি অবজ্ঞার ছাপ স্পষ্ট।
সাজিদ বলল, -‘ বেশ ! তোমাদের গরু আছে?’
-‘আছে’
-‘কয়টা?’
ছেলেটার বাবা বললেন, -‘হ বাপ। মোগো গরু আছে পাচ খান। দুইডা গাই, এক্কুয়া ষাঁড় গরু। লগে আবার বাছুরও আছে দুইডা।
-‘আচ্ছা রফিক, ধরো-তোমাদের যে দুটি গাভী আছে, তাদের এই দুটি করে বাচ্চা দিল। তাহলে তোমাদের মোট গরুর সংখ্যা হবে নয়টি। ধরো, তোমরা পশু হত্যায় বিশ্বাসী নও। তাই তোমরা গরুগুলো বিক্রিও করো না। কারণ, তোমরা জানো বিক্রি হলে গরুগুলো কোথাও না কোথাও কুরবানী হবেই। ধরো, এরপরের বছর গরু গুলো আরো দুটি করে বাচ্চা দিল। মোট গুরু তখন ১৩ টি। এর পরের বছর দেখা গেল, বাছুরগুলোর মধ্যে থেকে দুটি গাভী হয়ে উঠল, যারা বাচ্চা দিবে। এখন মোট গাভীর সংখ্যা চারটি। ধরো, চারটি গাভী এর পরের বছর আরো দুটি করে বাচ্চা দিবে। তাহলে সে বছর তোমাদের মোট গরুর সংখ্যা কত দাড়ালো?’
ছেলেটির বাবা আঙুল হিসাব কষে বললেন, -‘হ, ১৯ টা অইবে।’
সাজিদ বলল, -‘বলতো রফিক, ১৯ টা গরু রাখার মত জায়গা তোমাদের আছে কিনা? ১৯ টা গরুকে খাওয়ানোর মতো সামর্থ্য, পর্যাপ্ত ভুসি, খই, ঘাস আছে কি না তোমাদের?’
-‘না’ -ছেলেটা বলল।
-‘তাহলে আলটিমেটলি তোমাদের কিছু গরু বিক্রি করে দিতে হবে। এদের যারা কিনবে, তারা তো গরু কিনে গুদামে ভরবে না। তাই না? তারা গরু গুলোকে জবাই করে মাংস বিক্রি করবে। গরুর মাংস আমিষের চাহিদা পূরণ করবে আর চামড়াগুলো শিল্পের জন্য কাজে লাগবে। তাই না?’
-‘হুম’
-‘এটা হল প্রকৃতির ব্যালেন্স। তাহলে, প্রকৃতির ব্যালেন্স ঠিক রাখার জন্য পশুগুলোকে জবাই করতেই হচ্ছে। সেটা এমনি হোক অথবা কোরবানে।’
ছেলেটা বলল, -‘সেটা নিয়ে তো আপত্তি নেই। আপত্তি হচ্ছে, এটাকে ঘিরে উৎসব হবে কেন?’
সাজিদ বলল, -‘বেশ ! উৎসব বলতে তুমি হয়তো মীন করছো, যেখানে নাচ গান হয়, ফুর্তি হয়, আড্ডা, ড্রিঙ্কস হয়। মিছিল হয়, শোভাযাত্রা হয়, তাই না? কিন্তু দেখো, মুসলমানদের এই উৎসব সম্পূর্ণ ভিন্ন। এখানে নাচ গান নেই, আড্ডা মাস্তি নেই। ড্রিঙ্কস নেই, মিছিল শোভাযাত্রা নেই। আছে ত্যাগ আর তাকওয়ার পরীক্ষা। আছে, অসহায়ের মুখে হাসি ফোটানো প্রাণান্তকর চেষ্টা। শ্রেণি বৈষম্য দূর করে, সবার সাথে আনন্দ ভাগাভাগি করে নেওয়া হয়। এরকম উৎসবে সম্ভবত কারো দ্বিমত থাকার কথা না। কার্ল মাক্সকে চেনো?’
ছেলেটা এরপর কিছুক্ষন চুপ করেছিল। তারপর বলল, -‘আরজ আলী মাতুব্বরকে চিনেনে আপনি?’
সাজিদ বলল, -‘হ্যাঁ, চিনি তো’
-‘কোরবানি নিয়ে উনার কিছু যৌক্তিক প্রশ্ন আছে।’
-‘কি প্রশ্ন বলো।’
ছেলেটা প্রথম প্রশ্নটি বলল। সেটি ছিল –
‘আল্লাহ ইব্রাহিম এর কাছে তার সব চাইতে প্রিয় বস্তুর উৎসর্গের আদেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু ইব্রাহিম এর কাছে সবচেয়ে প্রিয় বস্তু তার ছেলে ইসমাইল না হয়ে, তার নিজ প্রান কেন হল না?’
সাজিদ মুচকি হেসে বললো, -‘খুবই লজিক্যাল প্রশ্ন বটে।’
-‘আমি যদি আরজ আলী মাতব্বরের সাক্ষাৎ পেতাম, তাহলে জিজ্ঞেস করতাম বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে যারা যুদ্ধ করে শহীদ হয়েছে, তাদের কাছে তাদের নিজের প্রানের চেয়ে দেশটা কেন বেশি প্রিয় হলো? কেন দেশরক্ষার জন্য নিজেদের প্রাণটাকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিল?
দুটো জিনিসই সেইম ব্যাপার। ইব্রাহীমের কাছে নিজের চেয়েও প্রিয় ছিল পুত্রের প্রাণ, আর মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে নিজের প্রানের চেয়ে প্রিয় ছিল নিজের মাতৃভূমি।
কিন্তু পরীক্ষার ধরন ছিল আলাদা। ইব্রাহিমকে বলা হলো, প্রিয় জিনিস কোরবানি করতে, আর মুক্তিযোদ্ধাদের বলা হলো প্রিয় জিনিস রক্ষা করতে। কিন্তু, আমরা দেখতে পেলাম দুজনের কারো কাছেই প্রিয় বস্তু নিজের প্রান নয়। সুতরাং আরজ আলী মাতব্বরের মাতব্বরিটা এখানে ভুল প্রমাণিত হলো।’
ছেলেটা কাচুমাচু করে দ্বিতীয় প্রশ্ন করল ।
আরজ আলী মাতব্বর বলেছেন, -‘আল্লাহ পরীক্ষাটা করেছেন ইব্রাহিমকে। ইব্রাহিম এর পদাঙ্ক অনুসরণ করে সেই পরীক্ষাটা কেন তার অনুসারীদের দিতে হবে?’
সাজিদ বললো, -‘এইটা খুব ভালো প্রশ্ন। আমরা মুহাম্মদ সা. কে অনুসরন করি। তাহলে আমরা কি বলতে পারি যে, -কই আমাদের উপর তো জিবরাঈল আঃ ওহী নিয়ে কখনো আসে নাই। তাহলে মোহাম্মদের উপর আসা ওহী আমরা কেন মানতে যাবো? বলো প্রশ্নটা কি আমরা করতে পারি?’
ছেলেটা চুপ করে আছে। সাজিদ বলল, -‘আরজ আলী মাতুব্বরের Leader & Leadership আদতে কোন জ্ঞানই ছিল না। তাই তিনি এরকম প্রশ্ন করে নিজেকে সক্রেটিস বানাতে চেয়েছিলেন।
ছেলেটা তার তৃতীয় প্রশ্ন করল-
‘আরজ আলী মাতুব্বর বলেছেন, -নবী ইব্রাহিমকে তো কেবল ইসমাইলকে কুরবানী করা সংক্রান্ত পরীক্ষাই দিতে হয়নি, অগ্নিকুন্ডে নিক্ষিপ্ত হবার মতো কঠিন পরীক্ষাও তাকে দিতে হয়েছিল। তাহলে মুসলমানরা ইব্রাহিমের স্মৃতি ধরে রাখতে পশু কোরবানি করলেও ইব্রাহিমের আর একটি পরীক্ষা মতে -মুসলমানরা নিজেদের অগ্নিকুন্ডে নিক্ষেপ করে না কেন?’
আরজ আলী মাতুব্বরের আগের প্রশ্নগুলো আমার কাছে শিশুসুলভ মনে হলেও, এই প্রশ্নটিকে অনেক ম্যাচিউর মনে হল। আসলেই তো। দুটোই ইব্রাহিম আঃ এর জন্য পরীক্ষা ছিল। তাহলে, একটি পরীক্ষা স্মৃতি ধরে রাখতে আমরা যদি পশু কুরবানী করি, তাহলে নিজেদের অগ্নিকুন্ডে নিক্ষেপ করি না কেন?
পদ্মা থেকে সাঁ সাঁ শব্দে বাতাস আসতে শুরু করেছে।
সাজিদ বলল, -‘রফিক, তার আগে তুমি আমার একটি প্রশ্ন উত্তর দাও। তুমি কি শেখ মুজিবকে ভালোবাসো? তার আদর্শকে?’
ছেলেটা বলল, -‘অবশ্যই। তিনি না হলে তো বাংলাদেশের অস্তিত্বই থাকত না। তিনি আমাদের জাতির পিতা।’
-‘তুমি ঠিক বলেছ। শেখ মুজিব না হলে বাংলাদেশে হয়তো কোনদিনই স্বাধীন হত না । সে যাহোক, শেখ মুজিবকে জীবনের দুটি বড় ধরনের পরীক্ষার মুখোমুখি হতে হয়েছিল।
প্রথমে, একটা দেশকে স্বাধীন করার লড়াইয়ে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেওয়া।
দ্বিতীয়ত, সপরিবারে খুন হওয়া। আমি কি ঠিক বললাম না রফিক?’
-‘হু’
-‘এখন, তুমি শেখ মুজিবের আদর্শ বুকে ধারণ কর। তুমি একাত্তরের চেতনায় নিজেকে বুলিয়ান ভাবো। তুমি ৭ ই মার্চের বিশাল মিছিলে যোগদান করো। ১৬ ই ডিসেম্বর সভা-সমাবেশে জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু বলে স্লোগান দাও। কিন্তু, ১৫ই আগস্টে রাস্তায় বেরিয়ে কোনদিন বলেছ, হে মেজর ডালিম এর বংশধর, হে খন্দকার মোশতাকের বংশধর, তোমরা কে কোথায় আছো, এসে আমাকেও মুজিবের মত সপরিবারে খুন করো। বলো কি?’
আমি সাজিদের কথা শুনে হো হো হো করে হাসা শুরু করলাম। ছেলেতার২ মুখ তখন একেবারে ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। সাজিদ আবার বলতে শুরু করল, -‘তুমি এটা বলো না। শেখ মুজিবের আদর্শ বুকে ধারণ করে এরকম কেউই এটা বলবে না। যদি কেউ এরকম বলে, তাহলে তাকে মানুষ বলবে, -কি ব্যাপার? লোকটাকে কি ভাদ্র মাসের কুকুরে কামড়িয়েছে নাকি?’
সাজিদের কথা শুনে রফিকের বাবাও হা হা হা করে হাসতে লাগলো। ছেলেকে পরাজিত হতে দেখে পৃথিবীর কোন বাবা এত খুশি হতে পারে, এই দৃশ্য না দেখলে বুঝতামই না।
আমরা রসুলপুরের দিকে হাটা ধরলাম। পদ্মা পাড়ের জনবসতিগুলো দেখতে একেবারে ছবির মতো। নিজেকে তখন হোসেন মিয়ার ময়না দ্বীপের বাসিন্দা মনে হচ্ছিলো। আর সাজিদ? তাকে আপাতত হোসেন মিয়া রূপেই ভাবতে পারেন।
No comments