কুরআন কি মুহাম্মদ (সা.) এর বানানো গ্রন্থ
কুরআন কি মুহাম্মদ (সা.) এর বানানো গ্রন্থ
বিরাট আলিশান একটি বাড়ি। মোঘল আমলের সম্রাটেরা যেরকম বাড়ি বানাতো, অনেকটাই সেরকম। বাড়ির সামনে দৃষ্টিনন্দন একটি ফুলের বাগান। ফুলের বাগানের মাঝে ছোট ছোট কৃত্রিম ঝর্ণা আছে। এই বাড়ির মালিকের প্রশংসা করতেই হয়। ঢাকা শহরের মধ্যে এটি যেন একটুকরো স্বর্গখন্ড।
কিন্তু অবাক করা ব্যাপার হল, বাগানের কোথাও লাল রঙের কোন ফুল নেই। এত বড় বাগানবাড়ি, অথচ কোথাও একটি গোলাপের চারা পর্যন্ত নেই। বিস্ময়য়ের ব্যাপার তো বটেই।
আমরা এসেছি সাজিদের দুর সম্পর্কের খালুর বাসায়। ঢাকা শহরে বড় বড় ব্যবসা আছে। বিদেশেও নিজের ব্যবসা বাণিজ্য শাখা প্রশাখা ছড়িয়েছেন। ছেলেমেয়েদের কেউ লন্ডন, কেউ কানাডা আর কেউ সুইজাল্যান্ডে থাকে। ভদ্রলোক উনার স্ত্রীকে নিয়ে ঢাকাতেই রয়ে গেছেন কেবল শিকড়ের টানে।
তবে, ঢাকায় নিজের বাড়িখানাকে যেভাবে তৈরি করেছেন, বোঝার উপায় নেই যে, এটি ঢাকার কোন বাড়ি, নাকি মস্কোর কোন ভিআইপি ভবন।
আমাকে এদিক সেদিক তাকাতে দেখে সাজিদ প্রশ্ন করল, -‘এভাবে চোরের মত এদিক ওদিক তাকাচ্ছিস কেনো?’
আমি ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়ার মত করে বললাম, -‘না, আসলে তোর খালুকে নিয়ে ভাবছি।’
-‘ওনাকে নিয়ে ভাবার কি আছে?’
আমি বললাম, -‘অসুস্থ মানুষদের নিয়ে ভাবতে হয়। এটাও এক প্রকার মানবতা, বুঝলি?’
সাজিদ আমার দিকে বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে বলল, -‘অসুস্থ মানে? কে অসুস্থ?’
-‘তোর খালু’
-‘তোকে কে বললো উনি অসুস্থ?’
আমি দাঁড়ালাম। বললাম, -‘তুই এত কিছু খেয়াল করিস, এটা করিস নি?’
-‘কোনটা?’
-‘তোর খালুর বাগানের কোথাও কিন্তু লাল রঙের কোন ফুলগাছ নেই। প্রায় সব রঙের ফুল গাছ আছে, লাল ছাড়া। এমনকি, গোলাপের একটি চারাও নেই।’
-‘তো?’
-‘তো আর কি? তিনি হয়তো রেড কালার ব্লাইন্ড। স্পেশিফিকলি, রেড কালার ব্লাইন্ড।’
সাজিদ কিছু বললো না। হয়তো সে এটা নিয়ে আর কোন কথা বলতে চাচ্ছে না। অথবা আমার যুক্তিতে সে হার মেনেছে।
সাজিদ কলিংবেল বাজালো।
ঘরের দরজা খুলে দিলো একটি তের-চৌদ্দ বছর বয়সী ছেলে। সম্ভবত কাজের ছেলে।
আমরা ভেতরে ঢুকলাম। ছেলেটি বলল, -‘আপনারা এখানে বসুন। আমি কাকাকে ডেকে দিচ্ছি।’
ছেলেটা একদম শুদ্ধ বাংলায় কথা বলছে। বাড়ির মালিককে স্যার বা মালিক না বলে কাকা বলছে। সম্ভবত উনার কোন গরীব আত্মীয়ের ছেলে হবে হয়তো। যাদের খুব বেশি টাকা পয়সা হয়, তারা গ্রাম থেকে গরীব আত্মীয়দের বাসার কাজের চাকরি দিয়ে দয়া করে।
ছেলেটা ভদ্রলোকটি ডাকার জন্য সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে গেল। ঘরের ভেতরটা আরো চমৎকার। নানান ধরনের দামি দামি মার্বেল পাথর দিয়ে দেয়াল সাজানো।
দু’তলার কোন এক রুম থেকে রবীন্দ্রনাথের গানের সুর ভেসে আসছে, -‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে, তবে একলা চলো রে…..’
আমি সাজিদকে বললাম, -‘কিরে তোর এরকম মোঘলাই স্টাইলের একটা খালু আছে, কোনদিন বললি না যে?’
সাজিদ রসকষহীন চেহারায় বলল, -‘মোঘলাই স্টাইলের খালু তো, তাই বলা হয়নি।’
-‘তোর খালুর নাম কি?’
-‘এম এম আলী।’
ভদ্রলোকের নামটা ওনার বাড়ির মতোই গাম্ভীর্যপূর্ণ। আমি জিজ্ঞেস করলাম, -‘এম এম আলী মানে কি?’
সাজিদ আমার দিকে তাকালো। বলল, -‘মোহাম্মদ মহব্বত আলী।’
ভদ্রলোকের বাড়ি আর ঐশ্বর্যের সাথে নামটা একদম যাচ্ছে না। এজন্য হয়ত মোহাম্মদ মহব্বত আলী নামটাকে শর্টকাট করে এম এম আলী করে নিয়েছেন।
ভদ্রলোক আমাদের সামনের সোফায় পায়ের উপর পা তুলে বসলেন। মধ্যবয়স্ক। চেহারায় বার্ধক্যের কোন ছাপ নেই। চুল পেকেছে, তবে কলপ করায় তা ভালোমতো বোঝা যাচ্ছে না।
তিনি বললেন। -‘তোমাদের মধ্যে সাজিদ কে?’
আমি লোকটার প্রশ্ন শুনে অবাক হলাম খুব। সাজিদের খালু, অথচ সাজিদকে চিনে না। এটা কি রকম কথা?
সাজিদ বলল, -‘জি, আমি।’
-‘হুম, I guessed that’ –লোকটা বলল। আরো বলল, -‘তোমার কথা বেশ শুনেছি, তাই তোমার সাথে আলাপ করার ইচ্ছে জাগলো।’
আমাদের কেউ কিছু বললাম না। চুপ করে আছি।
লোকটা আবার বলল, -‘প্রথমে আমার সম্পর্কে দরকারি কিছু কথা বলে নিই। আমার পরিচয় তো তুমি জানোই, সাজিদ। যেটা জানো না, সেটা হলো, -বিশ্ববিদ্যালয় জীবন থেকে আমি একজন অবিশ্বাসী। খাঁটি বাংলায় নাস্তিক। হুমায়ুন আজাদকে তো চেনো, তাই না? আমরা একই ব্যাচের ছিলাম। আমি নাস্তিক হলেও আমার ছেলেমেয়েরা কেউই নাস্তিক নয়। সে যাহোক, এটা নিয়ে আমার মাথা ব্যাথা নেই। আমি ব্যক্তি স্বাধীনতায় বিশ্বাসী।’
সাজিদ বলল, -‘খালু, আমি সব জানি।’
লোকটা অবাক হবার ভান করে বললো, -‘জানো? ভেরি গুড। ক্লেভার বয়।’
-‘খালু, আমাকে ডেকে পাঠিয়েছেন কেন তা বলুন।’
-‘ওয়েট ! তাড়াহুড়া কিসের?’ -লোকটা বলল।
এরই মধ্যেই কাজের ছেলেটা ট্রেতে করে চা নিয়ে এল। আমরা চায়ের কাপে চুমুক দিলাম। লোকটাকে একটি আলাদা কাপে চা দেয়া হল। সেটা চা নাকি কফি, ঠিক বোঝা যাচ্ছে না।
লোকটি বলল, -‘সাজিদ, আমি মনে করি, তোমাদের ধর্মগ্রন্থ, আই মিন আল-কোরআন, সেটা কোন ঐশী গ্রন্থ নয়। এটা মোহাম্মদের নিজের লেখা একটি বই। মোহাম্মদ করেছে কি, এটাকে জাস্ট স্রষ্টার বাণী বলে চালিয়ে দিয়েছে।’
এইটুকু বলে লোকটা আমাদের দুজনের দিকে তাকাল। হয়তো বোঝার চেষ্টা করলো আমাদের রিএকশন কি হয়।
কিছু বলার আগেই লোকটি আবার বলল, ‘হয়তো বলবে, মুহাম্মদ লিখতে-পড়তে জানত না। সে কিভাবে এরকম একটি গ্রন্থ লিখবে? ওয়েল। এটা খুব লেইম লজিক। মুহাম্মদ লিখতে পড়তে না জানলে কি হবে, তার ফলোয়ারদের অনেকে লিখতে পড়তে পারতো। উচ্চশিক্ষিত ছিল। তারা করেছে কাজটা মোহাম্মদের ইশারায়।’
সাজিদ তার কাপে শেষ চুমুক দিল। তখনও সে চুপচাপ।
লোকটা বলল, -‘কিছু মনে না করলে আমি একটি সিগারেট ধরাতে পারি? অবশ্য কাজটি ঠিক হবে না জানি।’
আমি বললাম, -‘শিওর !’
এতক্ষণ পরে লোকটি আমার দিকে ভালো মত তাকালো। একটি মুচকি হাসি দিয়ে বলল, -‘Thank you’
সাজিদ বলল, -‘খালু, আপনি খুবই লজিক্যাল কথা বলেছেন। কোরআন মুহাম্মদ সা. এর নিজের বানানো হলেও হতে পারে। কারণ, কুরআন যে ফেরেশতা নিয়ে আসতো বলে দাবি করা হয়, সেই জিব্রাইল আঃ কে মুহাম্মদ সা. ছাড়া কেউই কোনো দিন দেখেনি।’
লোকটা বলে উঠল, -‘এক্সাক্টলি, মাই সান’
-‘তাহলে, কোরানকে আমরা টেস্ট করতে পারি, কি বলেন খালু?’
-‘হ্যাঁ হ্যাঁ, করা যায়…..’
সাজিদ বলল, -‘কোরআন মুহাম্মদ সা. এর বানানো কিনা, তা বুঝতে হলে আমাদের ধরে নিতে হবে যে, মুহাম্মদ সা. স্রষ্টার কোন দূত নন। তিনি খুবই সাধারন, অশিক্ষিত একজন প্রাচীন মানুষ।’
লোকটা বলল, -‘সত্যিকার অর্থে মোহাম্মদ অসাধারণ কোন লোক ছিলেন না। স্রষ্টার দূত তো পুরোটাই ভুয়া।’
সাজিদ মুচকি হাসলো। বললো, -‘তাহলে এটাই ধরে নেই?’
-‘হুম’- লোকটার সম্মতি।
সাজিদ বলতে লাগল। -‘খালু ইতিহাস থেকে আমরা জানতে পারি হযরত ইউসুফ আঃ এর জন্ম হয়েছিল বর্তমান ফিলিস্তিনে। ইউসুফ আঃ ছিলেন হযরত ইয়াকুব আঃ এর কনিষ্ঠতম পুত্র। ইয়াকুব আঃ এর কাছে ইউসুফ আঃ ছিলেন প্রাণাধিক প্রিয়। কিন্তু, ইয়াকুব আঃ এর ভালোবাসা ইউসুফ আঃ এর জন্য কাল হলো। তার ভাইয়েরা ষড়যন্ত্র করে ইউসুফ আঃ কে কূপে নিক্ষেপ করে দেয়। এরপর, কিছু বনিকদল কূপ থেকে ইউসুফ আঃ কে উদ্ধার করে তাকে মিশরে নিয়ে আসে। তিনি মিশরের রাজ পরিবারে বড় হন। ইতিহাস মতে, এটি ঘটে খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতকের আমেনহোটেপ এর রাজত্বকালের আর তিনশো বছর পূর্বে। খালু, এই বিষয়ে আপনার কোন দ্বিমত আছে?’
লোকটা বলল, -‘নাহ। কিন্তু, এগুলো দিয়ে তুমি কি বোঝাতে চাও?’
সাজিদ বলল, -‘খালু, ইতিহাস থেকে আমরা আরো জানতে পারি, খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতকে চতুর্থ আমেনহোটেপ এর আগে যে সকল শাসকেরা মিশরকে শাসন করেছে, তাদের সবাইকেই ‘রাজা’ বলে ডাকা হতো। কিন্তু খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতকে চতুর্থ আমেনহোটেপ এর পরে যে সকল শাসকেরা মিশরকে শাসন করেছিল তাদের সবাইকে ‘ফেরাউন’ বলে ডাকা হতো। ইউসুফ সা. মিশরকে শাসন করেছিলেন খ্রিস্টপূর্ব চতুর্দশ শতকের চতুর্থ আমেনহোটেপ এর আগে। আর, মুসা আঃ মিশরে জন্ম লাভ করেছিলেন চতুর্থ আমেনহোটেপ এর কমপক্ষে আরও ২০০ বছর পরে। অর্থাৎ, যখন জন্মগ্রহণ করেন, তখন মিশরের শাসকদের আর ‘রাজা’ বলা হতো না, ‘ফেরাউন’ বলা হতো।’
-‘হুম, তো?’
-‘কিন্তু খালু, কোরআনে ইউসুফ আঃ এবং মুসা আঃ দুইজনের কথাই আছে। অবাক করা ব্যাপার হচ্ছে, কোরআন ইউসুফ আঃ এর বেলায় শাসকদের ক্ষেত্রে ‘রাজা’ শব্দ ব্যবহার করলেও, একই দেশের, মুসা আঃ এর সময়কার শাসকদের বেলায় ব্যবহার করেছে ‘ফিরাউন’ শব্দটি। বলুন তো খালু, মরুভুমির বালুতে উট চরানো বালক মুহাম্মদ সা. ইতিহাসের এই পাঠ কোথায় পেলেন? তিনি কিভাবে জানতেন যে ইউসুফ আলাই সালাম এর সময়ের শাসকদের রাজা বলা হতো মুসা আলাই সাল্লাম এর সময়কার শাসকদের ফেরাউন এবং ঠিক সেই মতো শব্দ ব্যবহার করে তাদের পরিচয় দেওয়া হল?
মহব্বত আলী নামের ভদ্রলোকটি হো হো হো করে হাসতে লাগলো। বললো, -‘মুসা আর ইউসুফ এর কাহিনী তো বাইবেলেও ছিল। সেখান থেকে কপি করেছে, সিম্পল।’
সাজিদ মুচকি হেসে বলল, -‘খালু ম্যাটার অফ সরো দ্যাট, বাইবেল এই জায়গায় চরম একটি ভুল করেছে। বাইবেল ইউসুফ আঃ এবং মুসা আঃ দুজনে সময়কার শাসকদের জন্যই ‘ফেরাউন’ শব্দ ব্যবহার করেছে, যা ঐতিহাসিক ভুল। আপনি চাইলে আমি আপনাকে বাইবেলের ওল্ড টেস্টামেন্ট থেকে প্রমাণ দেখাতে পারি।’
লোকটা কিছুই বলল না চুপ করে আছে। সম্ভবত উনার প্রমান দরকার হচ্ছে না। সাজিদ বলল, -‘যে ভুল হয় বাইবেল করেছে, সে ভুল অশিক্ষিত আরবের বালক মুহাম্মদ সা. এসে ঠিক করে দিল, তা কিভাবে সম্ভব, যদি না তিনি কোন প্রেরিত দূত হন, আর কোরআন কোন ঐশী গ্রন্থ না হয়?’
লোকটি চুপ করে আছে। এর মধ্যেই তিনটি সিগারেট খেয়ে শেষ করেছে। নতুন আরেকটি ধরাতে ধরাতে বলল, -‘হুম, কিছুটা যোক্তিক।’
সাজিদ আবার বলতে লাগল, -‘খালু, কোরআনে একটি সূরা আছে। সূরা আল ফজর নামে। ৬ নম্বর আয়াতটি এরকম, -‘তোমরা কি লক্ষ্য করনি, তোমাদের পালনকর্তা ইরাম গোত্রের সাথে কিরূপ ব্যবহার করেছেন?’
এই সূরা ফাজরে মূলত আদ জাতি সম্পর্কে বলা হয়েছে। আদ জাতির আলাপের মধ্যে হঠাৎ করে ‘ইরাম’ নামে একটি শব্দ চলে এলো, যা কেউই জানত না এটা আসলে কি। কেউ কেউ বলল, এটা আদ জাতির কোন বীর পালোয়ানের নাম, কেউ কেউ বলল, এই ইরাম হতে পারে আদ জাতির শারীরিক কোনো বিশেষ বৈশিষ্ট্য। কারণ এই সূরায় আদ জাতির শক্তিমত্তা নিয়ে আয়াত আছে। মোদ্দাকথা এই ইরাম আসলে কি সেটা সুস্পষ্ট কোনো ব্যাখ্যা কেউ দিতে পারেনি তখন। এমনকি গোটা পৃথিবীর কোন ইতিহাসে ইরাম নিয়ে কিছুই বলা ছিল না। কিন্তু ১৯৭৩ সালে ন্যাশনাল জিওগ্রাফি সিরিয়ার মাটির নিচে শহর এর সন্ধান পায়। এটি ছিল আদ জাতিদের শহর। সেই শহরে পাওয়া যায় সুপ্রাচীন উচু উচু দালান। এমনকি এই শহরে আবিষ্কার হয় তখনকার একটি লাইব্রেরী। লাইব্রেরীতে একটি তালিকা পাওয়া যায়। এই তালিকায় তারা যেসকল শহরের সাথে বাণিজ্য করতো সেসব শহরের নাম উল্লেখ ছিল। আশ্চর্যজনক হলেও সত্য এই -সেই তালিকায় ‘ইরাম’ নামের একটি শহরের নাম পাওয়া যায়, যেটা আদ জাতিদের একটি শহর ছিল। শহরটি ছিলো পাহাড়ের মধ্যে। এতেও ছিল সুউচ্চ দালান ।
চিন্তা করুন, যে ‘ইরাম’ শব্দের সঠিক ব্যাখ্যা এর পূর্বে তাফসিরকারকরাও করতে পারেনি। কেউ এটাকে বীরের নাম, কেউ এটাকে আদ জাতির শারীরিক বৈশিষ্ট্যের নাম বলে ব্যাখ্যা করেছে।
১৯৭৩ সালের আগে যে ‘ইরাম’ শহরের সন্ধান পৃথিবীর তাবৎ ইতিহাসে ছিল না, কোন ভূগোলবিদ, ইতিহাসবিদই এই শহরের সম্পর্কে কিছুই জানতো না, প্রায় ৪৩ শত বছর আগের আদ জাতিরদের সেই শহরের নাম কিভাবে কোরআন উল্লেখ করলো? যেটা আমরা জেনেছি ১৯৭৩ সালে, সেটা মুহাম্মদ সা. কিভাবে আরবের মরুভূমিতে বসে ১৪০০ বছর আগে জানলো? হাউ পসিবল? তিনিতো অশিক্ষিত ছিলেন। কোনদিন ইতিহাস-বা ভূগোল পড়েননি। কিভাবে জানলেন খালু?’
আমি খেয়াল করলাম, লোকটার চেহারা থেকে মোঘলাই ভাবটা সরে যেতে শুরু করেছে। পুত্রতুল্য ছেলের কাছ থেকে তিনি এতটা শক খাবেন, হয়তো আশা করেন নি।
সাজিদ আবার বলতে লাগল-
‘খালু আর রহমান নামে কোরআন একটি সূরা আছে। এই সূরার ৩৩ নম্বর আয়াতে বলা হচ্ছে, –
‘হে জিন ও মানুষ ! তোমরা যদি আসমান ও জমিনের সীমানায় প্রবেশ করতে পারো, তবে কর। যদি তোমরা তা পারবেনা প্রবল শক্তি ছাড়া।’
মজার ব্যাপার হলো, এই আয়াতটি মহাকাশ ভ্রমন নিয়ে। চিন্তা করুন, আজ থেকে চোদ্দশ বছর আগে আরবের লোক যাদের কাছে যানবাহন বলতে কেবল ছিল উট আর গাধা, ঠিক সেই সময়ে বসে মুহাম্মদ সা. মহাকাশ ভ্রমন নিয়ে কথা বলছে, ভাবা যায়?
সে যাহোক, আয়াতটিতে বলা হল, -‘যদি পারো আসমান ও জমিনের সীমানায় প্রবেশ করতে, তবে কর।’
এটি একটি কন্ডিশন ও (শর্তবাচক) বাক্য। এ বাক্যে শর্ত দেওয়ার জন্য If (যদি) ব্যবহার করা হয়েছে।
খালু, আপনি যদি অ্যারাবিক ডিকশনারি দেখেন, তাহলে দেখবেন আরবিতে ‘যদি’ শব্দের জন্য দুটি শব্দ আছে। একটি হল ‘লাও’ অন্যটি হলো ‘ইন’। দুটোর অর্থই ‘যদি’। কিন্তু এই দুটোর মধ্যে একটি সূক্ষ্ম পার্থক্য আছে। পার্থক্যটি হল -আরবিতে শর্তবাচক বাক্যে ‘লাও’ তখনই ব্যবহার করা হয়, যখন সেই শর্ত কোনোভাবেই পূরণ সম্ভব হবে না। কিন্তু শর্ত বাচক বাক্যে ‘যদি’ শব্দের জন্য ‘ইন’ ব্যবহার করা হয়, তখন নিশ্চয়ই এই শর্তটা পূরণ সম্ভব।
আশ্চর্যজনক ব্যাপার, কোরআনের সূরা আর রহমান এর ৩৩ নম্বর আয়াতে ‘লাও’ ব্যবহার না করে ‘ইন’ ব্যবহার করা হয়েছে। মানে কোন একদিন জ্বিন এবং মানুষেরা মহাকাশ ভ্রমণে সফল হবেই। আজকে কি মানুষ মহাকাশ জয় করে নি? মানুষ চাঁদে যায়নি? মঙ্গলে যাচ্ছে না ?
দেখুন, চৌদ্দশ বছর আগে যখন মানুষের ধারণা ছিল একটি ষাঁড় তার দুই শিং এর মধ্যে পৃথিবীকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, ঠিক তখন কোরআন ঘোষণা করছে, মহাকাশ ভ্রমনের কথা। সাথে বলেও দিচ্ছে, একদিন তা আমরা পারবো। আরবের নিরক্ষর মুহাম্মদ সা. কিভাবে এই কথা বলতে পারে?’
এম এম আলী ওরফে মোহাম্মদ মহব্বত আলী নামের এই ভদ্রলোকের চেহারা থেকে ‘আমি নাস্তিক, আমি একেবারে নির্ভুল’ টাইপ ভাবটা একেবারে উধাও হয়ে গেল। এখন তাকে যুদ্ধাহত এক ক্লান্ত সৈনিকের মত দেখাচ্ছে।
সাজিদ বলল, -‘খালু, খুব অল্প পরিমাণ বললাম। এরকম আরো শ’খানেক যুক্তি দিতে পারব যা দিয়ে প্রমাণ করে দেওয়া যায়, কোরআন মুহাম্মদ সা. এর নকল করে লেখা কোন কিতাব নয়। এটি স্রষ্টার পক্ষ থেকে আসা একটি ঐশী গ্রন্থ। যদি বলেন, মোহাম্মদ সা. নিজের প্রভাব বিস্তারের জন্য এই কিতাবে লিখছে, আপনাকে বলতে হয়, এই কিতাবের জন্যই মুহাম্মদ সা. কে বরণ করতে হয়েছে অবর্ণনীয় কষ্ট, যন্ত্রণা। তাকে বলা হয়েছিল, তিনি যা প্রচার করেছেন তা থেকে বিরত হলে তাকে মক্কার রাজত্ব দেওয়া হবে। তিনি তা গ্রহণ করেননি। খালু, নিজের ভাল তো পাগলেও বুঝে। মুহাম্মদ সা. বুঝলাম না কেন? এইসবই কি প্রমাণ করে না কোরআনের ঐশী সত্যতা?’
লোকটা কোন কথাই বলছে না। সিগারেটের প্যাকেটে আর কোন সিগারেট নেই। আমরা ঊঠে দাড়ালাম। বের হতে যাবো, অমনি সাজিদ ঘাড় ফিরে লোকটাকে বলল, -‘খালু একটি ছোট প্রশ্ন ছিল।’
-‘বলো।’
-‘আপনার বাগানে লাল রঙের ফুল গাছ নেই কেন?’
লোকটি বলল, -‘আমি রেড কালার ব্লাইন্ড। লাল রং দেখি না।’
সাজিদ আমার দিকে ফিরল। অবাক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, -‘জ্যোতিষী আরিফ আজাদ, ইউ আর কারেক্ট।’
No comments