Header Ads

রাসূলের একাধিক বিবাহের নেপথ্যে (প্যারাডক্সিক্যাল সাজিদ – ২)

                                     রাসূলের একাধিক বিবাহের নেপথ্যে



আমি আর সাজিদ বিশাল এক দালানের সামনে এসে দাঁড়ালাম। দালানের চারপাশ সুন্দর সব ফুলগাছে ভর্তি। একটি সাদা রঙের ফুলে আমার চোখ পড়ল। লাল রঙের টবে লিকলিকে এক লতা দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে। সেই লিকলিকে লতার গায়ে সেনাপতির মতো শৌর্যবীর্য নিয়ে কিছু সাদা রঙের ফুল যেন তার বাড়ন্ত যৌবনের জানান দিচ্ছে। ফুলগুলোর কাছে গেলাম। এধরণের ফুল আগে কখনোই দেখিনি। অদ্ভুত এক নেশাজাগানিয়া সুবাস ছড়াচ্ছে তারা। সেই মাতাল করা গন্ধে মৌ মৌ করছে বাতাস।

যেই আমি ফুলগুলো ছুঁতে যাব, অমনি বিশালাকার গোঁফওয়ালা এক লোক কোথেকে যেন দৌড়ে এসে আমার সামনে হাজির। এই লোকের যে শুধু গোঁফই বিশাল তা নয়, শরীরের তুলনায় তার মাথাটাও বিশাল সাইজের। আস্ত একটা ফুটবলের সমান মাথা নিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে লোকটি আমায় বলল, ফুলগাছে হাত দেওয়া নিষেধ, জানেন না?

তার প্রশ্ন শুনে আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেলাম। আশপাশে ভালোভাবে তাকালাম। কোথাও কোনো সাইনবোর্ডে লেখা নেই যে, ফুল ছেড়া ও ফুলগাছে হাত দেওয়া নিষেধ। ত্বরিতগতিতে চারদিকে একনজর তাকিয়ে কোনো নিষেধাজ্ঞামূলক বাণীর সন্ধান না পেয়ে তার দিকে ফিরলাম। দেখলাম লোকটি তখনো আমার দিকে মারমুখী চেহারা নিয়ে তাকিয়ে আছে। তার চোখ দুটোও স্বাভাবিকের তুলনায় বিশাল দেখাচ্ছে। মানুষ রেগে থাকলে যা হয় আর কি! কিন্তু এই লোক আমার ওপরে এত চটে বসার যথেষ্ট কোনো কারণ আমি খুঁজে পেলাম না। বললাম, ফুলগাছে হাত দিলে কী সমস্যা?

আমার কথা শুনে তার চোখ দুটো যেন আরও বিশাল হয়ে উঠল। নাকটাও ফুলে উঠছে ক্রমশ। বুঝতে পারছি, লোকটি এখনো রাগের সর্বশেষ ধাপে পৌঁছায়নি। ওই ধাপে গেলে তার চেহারার কী-যে অবস্থা হবে, কে জানে। খুব ইচ্ছে করছিল তার রাগের সর্বশেষ পারদ দেখে যাওয়ার। কোনো এক গল্পে পড়েছিলাম, একবার এক ব্যাঙ নিজেকে ফুলাতে ফুলাতে একসময় পটাশ করে ফেটে গিয়েছিল। এই লোকের ক্ষেত্রে সে রকম ঘটার সম্ভাবনা যদিও ক্ষীণ, তবুও তাকে রাগতে দেখে আমি কেমন যেন অদ্ভুত মজা পাচ্ছি। আমার নজর তখন সাদা রঙের ফুলগুলোর চেয়ে লোকটির ওপরেই বেশি। পাশ ফিরে সাজিদকে ডাকতে যাব, ওমা! অমনি দেখি সাজিদ ভ্যানিশ! কোথায় গেল সে?

পরে সাজিদকে আবিষ্কার করলাম অন্য জায়গায়। এই দালানের উত্তর-পূর্ব দিকে একটি কৃত্রিম ঝরনা আছে। বাঁধের মতো করে একটি ছোট্ট পুকুরসদৃশ কুয়া। সেখানে। বৈদ্যুতিক সংযোগের মাধ্যমে পানিকে সঞ্চারণ করে ওপর থেকে নিচের দিকে ফেলা হচ্ছে। সেই ঝরনার কাছে সে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। আমি অনেকটা লম্বা লম্বা পা ফেলে তার কাছে ছুটে এলাম। আমাকে এভাবে স্থান ত্যাগ করতে দেখে লম্বা গোঁফওয়ালা লোকটি নিশ্চয়ই খুব খুশি হয়েছে। সে নিশ্চয়ই ভাবছে আমি তার ভয়ে পালিয়ে এসেছি। বিজয়ীর মতো হেসে হেসে, গর্বে ফুলে ওঠা বুক নিয়ে সে নিশ্চয়ই তার জায়গায় চলে গেছে এতক্ষণে। তার চোখ আর নাকের কী অবস্থা, কে জানে! সেগুলো কি এখনো ফুলে-ফেঁপে আছে? নাকি চুপসে গেছে?

সাজিদের কাছে এসে বললাম, কীরে! এদিকে চলে এসেছিস যে? তোকে আমি খুজছিলাম চারদিকে।

সে আমার দিকে ফিরে বলল, কেন? দারোয়ানের ফোলানো নাক আর বিশালাকার চোখ দেখাতে?

যা বাবা! এই ব্যাপারটি সাজিদ কীভাবে জানল? সে তো আমার সাথে ছিল না সেখানে। আমি থতমত খেয়ে তার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি। সে আমার অবাক করা দৃষ্টিকে অগ্রাহ্য করে আবার ঝরনার দিকে মুখ ফেরাল। আমি তখনো এক অদ্ভুত বিস্ময় নিয়ে তার ঠিক পেছনে দাঁড়িয়ে আছি। হঠাৎ সে আমাকে বলল, আরিফ…?

এই ঝরনাটির দিকে তাকিয়ে দেখ!

কী দেখব?

কৃত্রিমতা দেখবি।

লাভ কী?

লাভ নেই।

তাহলে?

এবার সাজিদ আমার দিকে ফিরে বলল, মানুষ মনে করে কী জানিস? টাকা, বিশাল অট্টালিকা, দামি গাড়ি আর ঐশ্বর্যের মধ্যেই সুখ। এই ঐশ্বর্য আর ধন-সম্পদের পেছনে ছুটতে ছুটতে মানুষ এতই ব্যস্ত হয়ে পড়ে যে, স্রষ্টার অনুপম প্রকৃতিকে কাছ থেকে দেখার, সবুজাভ প্রকৃতির কাছে গিয়ে বুক ভরে নিঃশ্বাস নেওয়ার ফুরসত তার হয় না; কিন্তু সে জানে, দিনশেষে তার অট্টালিকা, তার বিশালাকার দালান তাকে মনোতৃপ্তি দিতে পারে না। সে এসবের মাঝে বন্দিজীবন পার করে; কিন্তু জীবন তাকে এমনভাবে আষ্টেপৃষ্ঠে ধরে যে, সে এই শৃঙ্খল থেকে কোনোভাবেই নিজেকে মুক্ত করতে পারে না। তবুও তার একটু ফুরসত চাই। একটু অবসর। সেই অবসর, মনোরম পরিবেশ স্রষ্টার প্রকৃতি ছাড়া কোথায় পাবে? সে নিজের ইচ্ছেমতো তৈরি করে নেয় ঝরনা, কৃত্রিম হ্রদ ইত্যাদি। দিনশেষে সব আইডিয়া স্রষ্টার কাছ থেকেই ধার করা…।

আমি মন দিয়ে সাজিদের এক নাগাড়ে বলে যাওয়া কথাগুলো শুনলাম। নিজ থেকে সে কখনোই আমার সাথে এভাবে কথা বলে না। তাকে কোনো কিছু জিজ্ঞেস করলে তার উত্তর দেয়, ব্যস! কিন্তু আজ তার এমন দার্শনিক কথাবার্তা দেখে আমি আরও একবার অবাক হলাম।

হঠাৎ একজন মধ্যবয়সী ভদ্রলোকের আগমন। আমার অবাক হবার রেশ কাটতে না কাটতেই তিনি জিজ্ঞেস করলেন, আপনাদের মধ্যে সাজিদ কে?

আমি সাজিদ বলল।

আপনাকে বড়দা যেতে বলেছেন।

সাজিদের এসব বড়দা, মেঝদা, ছোট দাদের আমি চিনি না। অবশ্য আমার চেনার কথা-ও না। সে কোন দিন কাকে, কোথায়, কখন যে অ্যাপয়েনমেন্ট দিয়ে রাখে সেটা আমিও বুঝতে পারি না। আজকে এসেছি তার কোনো এক বড়দার বাড়িতে। ইতিপূর্বে এই বিশাল বাড়িতে এসেছি বলেও আমি স্মরণ করতে পারছি না। সাজিদের পেছন পেছন হাঁটতে হাঁটতে তার সেই বড়দার ঘরে ঢুকে পড়লাম। ঘরটি বেশ পরিপাটি করে সাজানো। ঘরের আসবাবপত্র আর দেয়ালে টাঙানো কারুকাজ করা চিত্রকর্ম দেখেই বোঝা যায় লোকটি বেশ শৌখিন। বেতগাছের সোফার ওপর ভদ্রলোক পা লম্বা করে দিয়ে আধশোয়া হয়ে আছেন। এক হাতে সিগারেট, অন্য হাতে বই। সিগারেটটি জ্বলে শেষ হয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে; কিন্তু সেদিকে তার কোনো খেয়াল নেই। তিনি বইপড়ার মধ্যে মগ্ন হয়ে আছেন। সম্ভবত মজার কোনো বই-টই হবে।

সাজিদ গলা খাঁকারি দিয়ে ঘরের ভেতরে ঢোকে। সাজিদের গলার আওয়াজ শুনেই ভদ্রলোক ধড়ফড় করে উঠে দাঁড়ালেন। গোলগাল চেহারার এই লোকটি আমাদের দেখেই হাতে থাকা সিগারেট মাটিতে ফেলে পা দিয়ে পিষে থ্যাঁতলে দিয়ে বললেন, সাজিদ, এসো এসো, বসো। তিনি আমাদের সোফার দিকে ইশারা করে বসতে বললেন। আমি আর সাজিদ বাধ্যছেলের মতো সোজা গিয়ে সোফায় বসলাম। তিনি এবার তার রকিং চেয়ারে পায়ের ওপর পা তুলে দিয়ে বসলেন। ভদ্রলোকের চেহারার সাথে কার চেহারার যেন আমি অদ্ভুতরকম মিল পাচ্ছি। আমি কি এর আগে তাকে দেখেছি কোথাও? অথবা তার মতো কাউকে কি আমি চিনি? ঠিক মনে করতে পারছি না।


ভদ্রলোক বলে উঠলেন, তোমাদের কষ্ট হয়নি তো আসতে?

সাজিদ মাথা নেড়ে জানাল, না, কোনো কষ্ট হয়নি।

আমাদের আসতে কোনো কষ্ট হয়নি শুনে ভদ্রলোক পা দুখানা নামিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, তোমরা একটু বসো। আমি আসছি বলে তিনি ভেতরের ঘরে চলে গেলেন। আমি সাজিদকে বললাম, হ্যাঁ রে! লোকটার চেহারাটি বেশ চেনা চেনা মনে হচ্ছে। আগে কোথাও দেখেছি?

সাজিদ চুপ করে রইল।

খুব চেনা চেনা মনে হচ্ছে। আগে কোথাও দেখে থাকতে পারি কি?

তিনিই হয়তো ভালো বলতে পারবেন, এই বলে সাজিদ সোফার সামনে টি-টেবিলে থাকা বইটি উল্টাতে লাগল। রাশিয়ান লেখক ম্যাক্সিম গোর্কির লেখা মা উপন্যাসটি। কমিউনিস্ট আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে লেখা বিখ্যাত এই উপন্যাস সাজিদ এর আগেও কয়েকবার পড়েছে। যেহেতু উপন্যাসটি আগেই পড়া আছে, এই মুহূর্তে সেটি উল্টানোর কারণ কী? সাজিদের এমন গা-ছাড়া উত্তর শুনে আমার পিত্তি জ্বলে উঠল। ইচ্ছে করছিল তার পিঠে আস্ত একটি কিল বসিয়ে জবাব দিই; কিন্তু সম্ভব না। ভদ্রলোকের বাড়ি। এখানে বন্ধুত্বের ষোলকলা ফলাতে যাওয়া বিপদ। কোনোরকমে নিজেকে সংবরণ করে বললাম, আমি কিন্তু এরকম ঠাট্টা-টাইপ জবাবের আশায় প্রশ্নটি করিনি। তাকে সত্যিই খুব পরিচিত লাগছে। মনে হচ্ছে আগে কোথায় যেন দেখেছি।

দেখেও থাকতে পারিস।

তাকেই?


হয়তো তাকে অথবা তার মতো কাউকে। অসম্ভব তো না।

বুঝতে পারছি সাজিদ আমার সাথে লুকোচুরি খেলছে। সোজা আঙুলে যেমন ঘি ওঠে না, তেমনই সোজা কথায় ওর পেট থেকে মূল কাহিনি বের হয় না। ওর বাম কান মলে দিয়ে বললাম, সোজা কথার সোজা উত্তর দিতে কি তোর খুব কষ্ট হয়?

সাজিদ উহ! শব্দ করে বলল, ছাড়! ব্যথা লাগছে তো।

বল তাহলে এই লোককে কোথায় দেখেছি?

সাজিদ বুঝতে পারল আমি নাছোড়বান্দা। বলল, পৃথিবীতে কাছাকাছি চেহারার মানুষ তো থাকতেই পারে, তাই না? যেমন ধর সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। অনেকে বলে তার চেহারার সাথে রাজা রামমোহন রায়ের প্রথম যৌবনের চেহারার মিল আছে। এখন কেউ যদি রামমোহনের যৌবনকালের একটি ছবি এবং সুনীল দার যৌবনকালের ছবি পাশাপাশি দাঁড় করিয়ে বলে—এরা দুজন একই ব্যক্তি, সেটি কি ঠিক? আবার ধর হিটলারের কথা। কথিত আছে হিটলার একটি কারাগারে আগুন লাগিয়ে দিয়ে দুই হাজার কয়েদিকে হত্যা করেছিল। সেই কয়েদিদের মধ্যে জুলিয়ান নামে একজন কবিও ছিলেন। এর ঠিক দু-বছর পরে কবি জুলিয়ানকে আবার পশ্চিম জার্মানির রাস্তায় উলঙ্গ অবস্থায় হাওয়া খেয়ে ঘুরে বেড়াতে দেখা গেল। সবাই তো খুবই অবাক! অলৌকিক কাহিনি না তো? কিন্তু কবি জুলিয়ান এভাবে উলঙ্গ অবস্থায় ঘুরে বেড়াবে কেন? বোদ্ধা মহল সেই ঘটনার পক্ষেও যুক্তি দাঁড় করিয়ে ফেলল। তারা জানাল, কোনো এক অলৌকিক শক্তিবলে জুলিয়ান সেদিন প্রাণে বেঁচে যান; কিন্তু এমন আকস্মিক ঘটনার প্রভাব তিনি সইতে পারেননি। কথায় আছে, অধিক শোকে পাথর। বেচারা জুলিয়ান হয়তো অধিক শোকে পাথর হবার বদলে পাগল হয়ে যান। এরপর, একদিন জানা গেল এই পাগলটি আসলে জুলিয়ান ছিল না। হুবহু কবি জুলিয়ানের মতো দেখতে ছিল বটে। দেখ, মানুষ কতভাবেই-না বিভ্রান্ত হতে পারে, তাই না?

সাজিদের কথা শুনে আমার মাথায় যেন রক্ত চড়ে বসল। তার কাছে আমি শুনতে চাইলাম চর্যাপদের শ্লোক, সে আমাকে পুরো মহাভারত শুনিয়ে বসে আছে। আমি চোখ রাঙিয়ে বললাম, এই! তোর দার্শনিক কথাবার্তা অন্যদের জন্য তুলে রাখ। তোর কাছে এত প্যাঁচাল শুনতে চাইনি। রাজা রামমোহন রায় আর সুনীলের মধ্যকার সাদৃশ্য কীরকম, কিংবা কবি জুলিয়ান-নামার প্রাগৈতিহাসিক বর্ণনা তোর কাছে কি চেয়েছি? যা জানতে চেয়েছি তার উত্তর দে।

সাজিদ ধপ করে দমে গেল। কথা বলতে শুরু করার পর তাকে যদি কেউ থামিয়ে দেয়, তখন সে তার চেহারা ঠিক বাঙলা পাঁচের মতো বানিয়ে ফেলে। ঝুমবৃষ্টির পর প্রকৃতিতে যেমন একটি থমথমে অবস্থা বিরাজ করে, সাজিদের চেহারার ভাবটাও এই মুহূর্তে সেরকম। আমাদের মাঝে রীতিমতো একটি ঝগড়া শুরু হয়ে গেল। নীরব ঝগড়া। অবশেষে সে শান্ত গলায় বলল, লাস্ট ইয়ারে আমরা বার্সেলোনার যে চিড়িয়াখানায় গিয়েছিলাম, মনে আছে?

হ্যাঁ।

সেখানে এক লোক আমাদের বিরল প্রজাতির একটি সাদা রঙের গরিলা দেখিয়েছিল না?

হুম।

ওই লোকটার নাম মনে আছে?

ওই লোকটার নাম মনে করার চেষ্টা করলাম। কী যেন নাম ছিল? ধুর ছাই। মনে আসছে না। বললাম, ভুলে গেছি।

তার নাম ছিল ড্যানিয়েল।

ওহ হ্যাঁ, ড্যানিয়েল; মনে পড়েছে। তো?

তো আবার কী?

আমি তো তোর কাছে ড্যানিয়েল-সংক্রান্ত লঙ্কাকাহিনি শুনতে চাইনি। তোর সামনে উপবিষ্ট থাকা তোর বড়দার ব্যাপারে জানতে চেয়েছি। সাজিদ বলল, ওহ! ভুলে গিয়েছিলাম। এই সেই ড্যানিয়েল, যার সাথে আমাদের বার্সেলোনার চিড়িয়াখানায় দেখা হয়েছিল। আমাদের ইনিই তো পুরো চিড়িয়াখানা ঘুরিয়ে দেখিয়েছিলেন।

আমি যেন তাজ্জব বনে গেলাম। সাদা চামড়ার সেই স্প্যানিশ লোকটি কি জলবৎ তরলং করে বাংলা বলে যাচ্ছে! আমি সাজিদের দিকে ফিরে বললাম, দেখ সাজিদ, আজকাল তুই খুব বেশিই মজা করছিস। এরকম একজন নিখাদ বাঙালিকে তুই স্প্যানিশ ড্যানিয়েল বানিয়ে দিয়েছিস? তুই কি মনে করেছিস তোর সব ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ, কথাবার্তা আমি বিনাবাক্যে বিশ্বাস করে নেব? নেভার!

হঠাৎ আমাদের পেছন থেকে কথা বলে উঠলেন সাজিদের সেই বড়দা। তিনি বললেন, এক্সকিউজ মি, আরিফ। মে বি অ্যাই অ্যাম ইন্টারফেয়ারিং ইন ইওর পারসোনাল ডিসকাশন। বাট ইট সীমস লাইক ইউ আর মিসআন্ডারস্ট্যান্ডিং দ্য ভেরি পোলাইট বয়, সাজিদ। হি ইজ নট লাইয়িং অ্যাট অল। আই অ্যাম দ্যাট গাই উইথ হুম ইউ গাইস মেট অ্যাট দ্য জু অব বার্সেলোনা। আমার নাম ড্যানিয়েল। আমার জন্ম বাংলাদেশেই। খুলনাতেই আমি বেড়ে উঠেছি। আট বছর বয়সেই আমরা সপরিবারে স্পেন চলে যাই। দীনেশ আচার্য থেকে আমি হয়ে উঠি ড্যানিয়েল।

আমি কয়েক মুহূর্তের জন্য স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। এই লোক কী করে সেই লোক হতে পারে? স্পেনে যখন ছিলাম, এই লোক একটিবারের জন্যও আমাদের সাথে কেন বাংলা বলেননি? আর সাজিদের সাথে এই লোকের বিশেষ সম্পর্কটাই-বা কী? সবকিছু কেমন যেন তালগোল পাকিয়ে ফেলেছি…।

ড্যানিয়েল ওরফে দীনেশ আচার্য নামের লোকটি ট্রেতে করে কফি নিয়ে এসেছেন। চকোলেট রঙের কফির কাপগুলো আমাদের সামনে রেখে তিনি আবার নিজের জায়গায় গিয়ে বসলেন। পায়ের ওপর পা তুলে কফির কাপে চুমুক দিয়ে সাজিদের কাছে জানতে চাইলেন, তোমার মফিজুর রহমান স্যার কেমন আছেন, বলো তো?

আরে বাহ! সাজিদ এই লোকটার সাথে মফিজ স্যারের গল্পও করে রেখেছে, অথচ আমি দাবি করে থাকি সাজিদের প্রতিটি স্বাস-প্রশ্বাসের খবর আমার নখদর্পণে। নিজের ওপর নিজেরই খানিকটা রাগ হলো। সাজিদ উত্তরে বলল, জি, স্যার ভালো আছেন।

আচ্ছা, ভদ্রলোক তোমাকে আইনস্টাইন বলে ডাকেন কেন? আই মিন, ফিজিক্স তো তোমার বিষয় নয়। তোমার বিষয় হচ্ছে বায়োলজি। তিনি যদি তোমাকে কোনো উপনামে ডাকবেনই, তাহলে বায়োলজিতে বিরাট অবদান রেখেছে এরকম কোনো বিখ্যাত বিজ্ঞানীর নামানুসারে ডাকলেই পারেন। আইনস্টাইন তো বায়োলজির কেউ ছিলেন না।

সাজিদ বলল, ঠাট্টা করে ডাকেন।

ও আই সী।

ভদ্রলোক বললেন, আচ্ছা, ঠাট্টা করে আইনস্টাইন-ই বা ডাকতে হবে কেন?

সাজিদ একটু নড়েচড়ে বসে হাত থেকে কফির কাপটি রেখে বলল, আসলে, আইনস্টাইন এমন একটি ফিগার, যাকে বিজ্ঞান বা বিজ্ঞানের বাইরের যে কেউ চেনে। বিজ্ঞানের জগতে আইনস্টাইন যতটা পপুলার, ততটা আর কেউ হতে পারেননি। আপনি যদি টলেমি, কোপার্নিকাসদের নাম সাধারণ মানুষের কাছে বলেন, ওরা বোকা বোকা চোখে আপনার দিকে তাকাবে। সাধারণ মানুষ আইনস্টাইনকে যেভাবে চেনে বা তার নাম তারা যেভাবে শুনেছে, অন্য কারও নাম সেভাবে তারা শোনেনি। যেমন ধরুন, আমাকে যদি বায়োলজি ফিল্ডের সবচেয়ে বিখ্যাত ব্যক্তির নাম বলতে হয় আমি কিন্তু ডিএনএ-এর আবিষ্কারক স্যার ফ্রান্সিস ক্রিকের কথাই বলব। এখন মফিজুর রহমান স্যার যদি আমাকে ঠাট্টা করে মিস্টার আইনস্টাইন এর বদলে মিস্টার ফ্রান্সিস ক্রিক বলে ডাকেন, সম্ভবত কেউই তার এই ঠাট্টা ধরতে পারবে না। মানুষ ভাববে, আমার নাম বোধকরি সত্যি সত্যিই ফ্রান্সিস ক্রিক; কিন্তু আমাকে যখনই তিনি মিস্টার আইনস্টাইন বলে ডাকেন, তখন কিন্তু সবাই তার উপহাসটি ধরে ফেলে আর মজা পায়। হাসাহাসি করে। এটি হচ্ছে হিউম্যান সাইকোলজি। মানুষ তার পরিচিত বিষয়াদির বাইরের বিষয় নিয়ে খুব-একটা বুদ্ধি খাটাতে চায় না। এজন্যই বোধহয় মফিজুর রহমান স্যার আমাকে মিস্টার আইনস্টাইন সম্বোধন করেন।

গ্রেট! সুন্দর বলেছ সাজিদ। ইউ এক্সপ্লেইনড ইট কোয়াইট ইজিলি। ড্যানিয়েল নামের ভদ্রলোক হাত চাপড়ে বললেন। মফিজুর রহমান স্যার কেন সাজিদকে মিস্টার আইনস্টাইন নামে ডাকে সেই প্রশ্ন কখনোই আমার মনে আসেনি; কিন্তু সেই প্রশ্নের এত ভালো একটি ব্যাখ্যা থাকতে পারে জানলে আরও আগে সাজিদকে প্রশ্নটি করা যেত; কিন্তু সাজিদ কি ড্যানিয়েল নামের লোকটার কাছে মফিজুর রহমান স্যারের ব্যাপারে ওকালতি করল? যাওয়ার পথে জিজ্ঞেস করতে হবে…।

আমাদের আলোচনার ছেদ ঘটিয়ে ঘরের সামনের দরজার ওখান থেকে একজন বলে উঠলেন, গুড মর্নিং গাইস।

মুহূর্তেই আমাদের দৃষ্টি তার দিকে পড়ল। এই লোককে দেখতে মোটেও ব্রিটিশ বা স্প্যানিশ বলে মনে হয় না। বাংলার হাওয়া-জল আর মাটিতে গড়াগড়ি খেয়েই যে তার বেড়ে ওঠা, সেটি তার চেহারা আর শারীরিক গঠনই বলে দিচ্ছে। ভদ্রলোক হুড়মুড় করে ভেতরে এসে ড্যানিয়েল সাহেবের পাশের সোফায় গিয়ে বসলেন। সাজিদের বড়দা ওরফে ড্যানিয়েল সাহেব সাজিদের দিকে লক্ষ্য করে বললেন, রমেশ দা, তোমাকে যার কথা বলেছিলাম, এই হলো সে, সাজিদ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাইক্রো বায়োলজির ছাত্র। ভেরি ট্যালেন্টেড বয়।

আই সী, রমেশ নামের লোকটি সাজিদের দিকে তাকিয়ে হাসোজ্জ্বল মুখে বললেন।

ড্যানিয়েল সাহেব বললেন, সাজিদ, আজ যে-কারণে তোমাকে আসতে বলা। এই হচ্ছেন রমেশ আচার্য। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি সময়ে ইকোনোমিক্স পড়াতেন। রমেশ দার কাছে তোমার অনেক গল্প করেছি আমি। দাদার কিছু প্রশ্ন আছে। প্রশ্নগুলো ইসলাম নিয়ে। একটি ব্যাপার জানিয়ে রাখি, দাদা কিন্তু হিন্দু নন। ধর্ম, ঈশ্বর এবং পরকালে অবিশ্বাসী একজন নিখাদ নাস্তিক। তুমি কি দাদার প্রশ্নগুলো একটু শুনবে?

সাজিদ মাথা নেড়ে শোনার জন্য সম্মতি জানাল। ইতোমধ্যে রমেশ আচার্যের জন্যও এক কাপ কফি চলে এসেছে। কফির ধোঁয়া-ওড়া কাপে চুমুক দিয়ে তিনি বললেন, আমি যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি, সেই সময় ইউনিভার্সিটির হলে থাকতাম। আমার একজন রুমমেট ছিল, যে ইসলামিক স্টাডিজের ওপরে এম.ফিল করছিল। তার থিসিসের বিষয় ছিল মুহাম্মাদের জীবনী। তার থিসিসটি একবার আমাকে পড়তে দিয়েছিল সে। থিসিসটি পড়তে গিয়ে খেয়াল করলাম যে, মুহাম্মাদ নাকি এগারোটি বিয়ে করেছেন জীবনে। আই রিপিট, এ-গা-রো… আমাকে বলতে পারো, একজন লোকের জীবনে ঠিক এগারোজন স্ত্রীর দরকার পড়বে কেন?

বুঝতে পারলাম পুরোনো কাসুন্দি। সচরাচর নাস্তিকরা যে-সব প্রশ্ন পকেটে নিয়ে ঘোরে আর-কি! আরে বাবা, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এগারোটি বিয়ে করবেন, না পঁচিশটি করবেন, তা দিয়ে তোমাদের কী? এ-জাতীয় প্রশ্ন শুনলেই আমার পিত্তি জ্বলে ওঠে। নাস্তিক হয়েছ ভালো কথা, তাই বলে কারও ব্যক্তিগত জীবনে নাক গলাতে যাওয়া লাগবে কেন? যত্ত সব!

সাজিদ এরকম প্রশ্নগুলো শোনার পরে এখনো কীভাবে স্বাভাবিক রয়েছে আল্লাহ মালুম। আমার তো রাগে গা গিজগিজ করছে। হাত থেকে ম্যাক্সিম গোর্কির মা উপন্যাসটি রেখে সাজিদ বলল, আমি কি আপনাকে রমেশ দা বলে ডাকতে পারি?

অবশ্যই পারো, সামনে উপবিষ্ট লোকটি বলল।

আচ্ছা রমেশ দা, আপনি কি মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবনী কখনো পড়েছেন?

তা পড়িনি অবশ্য। তবে নানাজনের কাছ থেকে কিছু কিছু ব্যাপারে শুনেছি।

লোকটার কথা শুনে আমার মাথা গরম হয়ে গেল। বলে ফেললাম, আপনি যখন তার কোনো জীবনীই পড়েননি, তাহলে প্রশ্নের ঝুলি নিয়ে ঘুরছেন কীভাবে? কোনো কিছু নিয়ে প্রশ্ন করতে হলে আগে সে সম্পর্কে পড়াশোনা করতে হয়। এই কমন-সেটুকুও কি আপনাদের নেই?

আমার জোরালো ও ঝাঁঝালো বক্তব্য শুনে দীনেশ আচার্য এবং রমেশ আচার্য, দুই আচার্য মিলে আমার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকাল। বুঝতে পেরেছি, আমার গলার সুর একটু বেশিই উঁচু করে ফেলেছি। পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য সাজিদ বলল, ফাইন! প্রশ্ন করার জন্যে যে, আগে সে ব্যাপারে ব্যাপক পড়াশোনা থাকতে হবে, ব্যাপারটি এমন নয়। এটি একটি ভুল ধারণা। প্রশ্ন যে-কারও থাকতে পারে। একটি ছোট শিশু যখন আকাশের চাঁদ দেখে প্রশ্ন করে, তখন তার অবশ্যই জানা লাগে না যে, চাঁদ হলো একটি উপগ্রহ। এটি পৃথিবী থেকে এত কিলোমিটার দূরে। এটার ভূপৃষ্ঠ অমুক-তমুক পদার্থ দিয়ে গঠিত। প্রশ্ন করার জন্য তার সে ব্যাপারে পূর্ণাঙ্গ এবং পরিপূর্ণ জ্ঞান থাকার প্রয়োজন নেই। যদি থাকত, তাহলে সে-বিষয়ে তার মনে প্রশ্ন জাগত না।

সাজিদের গোছালো বক্তব্য শুনে আমি চুপসে গেলাম। আপাতবিরোধী মনে হলেও তার কথায় যুক্তি আছে। সে আবার বলতে শুরু করল, তাহলে রমেশ দা, আপনি মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কোনো জীবনীই পড়েননি?

না।

কোনো সমস্যা নেই। আপনার প্রশ্নটি হচ্ছে, কেন তিনি এগারোটি বিয়ে করেছিলেন, রাইট? একজন মানুষের জীবনে এতগুলো স্ত্রীর দরকার পড়বে কেন, এই তো?

হ্যাঁ।

ভেরি গুড। আচ্ছা, আপনি কি জানেন, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঠিক কত বছর বয়সে প্রথম বিয়ে করেছিলেন এবং কাকে বিয়ে করেছিলেন?

নামটি এক্সাক্টলি মনে পড়ছে না। তবে কোনো ব্যবসায়ী নারীকে বিয়ে করেছিলেন এ্যাজ ফার এ্যাজ আই ক্যান রিমেম্বার।

একদম ঠিক। তিনি বিয়ে করেছিলেন একজন ব্যবসায়ী নারীকে। তার নাম ছিল খাদিজা বিনতে খুওয়াইলিদ। মানে, খুওয়াইলিদ নামের এক ব্যক্তির কন্যা, যার নাম ছিল খাদিজা। মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন তাকে বিয়ে করেন, তখন মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বয়স ছিল পঁচিশ বছর। আর খাদিজা বিনতে খুওয়াইলিদের বয়স কত ছিল জানেন?

রমেশ আচার্য জানতে চাইল, কত?

চল্লিশ বছর।

ও, আই সী, বলল রমেশ আচার্য নামের ভদ্রলোক।

কিন্তু আপনি কি আমাকে বলতে পারেন, একজন সুদর্শন পুরুষ, যখন তার টগবগে তারুণ্য, ভরা যৌবনকাল, তখন ঠিক কীসের জন্যে তিনি চল্লিশ বছরের একজন নারীকে বিয়ে করলেন যখন তার যৌবনকাল অস্তমিত প্ৰায়? শুধু কি তা-ই? এই চল্লিশোর্ধ্ব নারী ছিলেন একজন বিধবাও। আমাকে বলুন তো, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মতো একজন তরুণ, যার কি না তখন যৌবনের উচ্ছলতায় মেতে ওঠা কোনো সুদর্শন তরুণীকেই বিয়ে করাটাই ছিল যুক্তিসংগত, তিনি কেন স্ত্রী হিশেবে বেছে নিলেন একজন বিধবা, চল্লিশোর্ধ্ব বয়সের নারীকে?

মে আই ইন্টারফেয়ার হিয়ার? বললেন দীনেশ আচার্য ওরফে মি. ড্যানিয়েল।

শিওর, সাজিদ বলল।

আমার মনে হয় কি সাজিদ, খাদিজা নামের যে ব্যবসায়ী নারীর কথা তুমি বললে, তার অঢেল সম্পত্তি, ব্যবসায় ইত্যাদির মালিকানা হস্তগত করার জন্যেই মুহাম্মাদ আসলে তাকে বিয়ে করেছে। আই ডোন্ট নো হোয়্যাট দ্য একচুয়াল ম্যাটার ইজ, বাট এটি একটি পয়েন্ট হতে পারে বলে আমার মনে হয়েছে।

মধ্যবয়স্ক এক চাচা গোছের মানুষ আমাদের জন্যে আবার কফি নিয়ে এসেছেন। কফির কাপগুলো টেবিলে রাখামাত্রই তিনি সুড়সুড় করে হেঁটে ভেতরে চলে গেলেন। মি, ড্যানিয়েল সাহেব আমাদের সকলকে আবারও কফি পরিবেশন করলেন। ধোঁয়া-ওড়া কফির কাপে চুমুক দিয়ে সাজিদ বলতে শুরু করল, হ্যাঁ, এটি একটি চমৎকার পয়েন্ট বটে; কিন্তু আপনি যদি ইতিহাসের পাতা উল্টান, এমনকি যদি আপনি ক্রিশ্চিয়ান মিশনারি, ওরিয়েন্টালিস্টদের লেখা বইপত্রও ঘাঁটেন, তাহলে কোথাও আপনি এর পক্ষে বিন্দুমাত্র প্রমাণ পাবেন না।

কীসের পক্ষে? রমেশ দার প্রশ্ন।

এই যে, বড়দা যেটি বললেন, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নাকি ব্যবসায়-সম্পত্তির লোভেই খাদিজার মত বয়স্ক ও বিধবা নারীকে বিয়ে করেছেন।

তাহলে এর পেছনের রহস্য কী?

কোনো রহস্য-টহস্য নেই আসলে। তৎকালে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বিশ্বাসযোগ্যতা, সত্যবাদিতা, কর্মনিষ্ঠা ও সুন্দর আচরণের কথা মক্কার সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। এই সংবাদ মক্কার বিশিষ্ট ব্যবসায়ী খাদিজা বিনতে খুওয়াইলিদের কানেও চলে যায়। অনেকদিন থেকে তিনি তার ব্যবসায় পরিচালনার জন্যে এরকম একজন সৎ, বিচক্ষণ, সত্যবাদী, ন্যায়পরায়ণ ও কর্মনিষ্ঠ লোক খুঁজছিলেন। মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ব্যাপারে এরকম প্রশংসা শুনে তিনি তাকে একটু যাচাই করে নিতে চাইলেন। এই উদ্দেশ্যে তিনি তাকে কিছু কাজ দিয়ে বণিকদের সাথে সিরিয়ায় পাঠালেন। সাথে বিশেষ এক সহচর নিযুক্ত করলেন, যাতে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে পুরো সফরে খুব কাছ থেকে ভালোভাবে, অবজার্ভ করা যায়। তার ব্যাপারে লোকমুখে যে সুনাম, যে প্রশংসা চাউর হয়ে আছে, তা আদৌ সত্য কি না, সেটি যাতে হাতেনাতে প্রমাণিত হয়। যখন মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সিরিয়া-সফর থেকে ফিরলেন, সেবার ব্যবসায় প্রচুর মুনাফা হয় এবং তিনি তার হিশাবপত্রেও ছিলেন একেবারেই নির্ভুল, স্বচ্ছ এবং সৎ। খাদিজার নিযুক্ত করা সহচরও মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ব্যাপারে খুব ইতিবাচক ফলাফল প্রদান করলেন। সব দেখেশুনে খাদিজা রাযিয়াল্লাহু তাআলা আনহার মনে হলো যে, এই তরুণকে চাইলেই বিয়ের প্রস্তাব দেওয়া যায় এবং তিনি মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বিয়ের প্রস্তাব দেন। মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এই ব্যাপারে অভিভাবক হিশেবে তার চাচা আবু তালিবকে সাব্যস্ত করেন। পরবর্তীতে আবু তালিবের সম্মতিতে খাদিজার সাথে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বিয়ে সম্পন্ন হয়। এটাই হচ্ছে পুরো এবং প্রকৃত ঘটনা। এবার বলুন তো, এই ঘটনার কোথাও কি সম্পত্তির প্রতি লোভ আছে? অর্থের প্রতি লোভ আছে? নাকি ব্যবসায়ে মালিকানা হস্তগত করার কোনো পূর্বপরিকল্পনা বা দুরভিসন্ধি আছে?

রমেশ আচার্য নামের লোকটি পায়ের ওপর পা তুলে বলল, ইফ দ্যা কেইস ইজ দিস, দ্যান ইটস ওকে।

সাজিদ বলতে লাগল, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বহুবিবাহের প্রসঙ্গ টেনে মূলত নাস্তিকরা যা বোঝাতে চায় তা হলো, তিনি নাকি নারীলোভী ছিলেন। অথচ আপনি যদি ইতিহাসের পাতা খুলে দেখেন, তাহলে দেখবেন যে, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার যৌবন, পড়ন্ত যৌবন এবং বার্ধক্যেরও কিছুটা সময় পার করেছেন তার প্রথম স্ত্রী খাদিজার সাথেই। প্রথম স্ত্রী যতদিন বেঁচে ছিলেন, ততদিন মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আর কাউকে বিয়ে করেননি। মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বয়স যখন পঞ্চাশ বছর, যখন তার যৌবন শেষ হয়ে শরীরে বার্ধক্য নেমে আসে তখন তার প্রিয় সহধর্মিনী খাদিজা রাযিয়াল্লাহু আনহার মৃত্যু হয়।

নাস্তিকরা যাকে নারীলোভী আখ্যায়িত করতে চায়, সে-ই তিনিই নাকি ভরা যৌবনের সবটুকু সময় অর্থাৎ-পঁচিশটি বছর কাটিয়ে দিয়েছেন একজন স্ত্রীর সাথেই। নাস্তিকদের দাবি যদি সত্যি হতো, তাহলে এই পঁচিশ বছরে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অন্তত পাঁচ-পাঁচটি স্ত্রী থাকা উচিত ছিল; কিন্তু ইতিহাসে এরকম কোনো প্রমাণ নেই। এ থেকে কী প্রমাণিত হয়? এ থেকে প্রমাণিত হয় যে নাস্তিকদের যুক্তিটি অত্যন্ত দুর্বল এবং অযৌক্তিক।

তাহলে বাদবাকি বিয়েগুলো? সেগুলোর ব্যাপারে কী বলবে তুমি? বলে উঠলেন মি. ড্যানিয়েল।

বলছি। মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন চল্লিশ বছর বয়সে নবুওয়াত প্রাপ্ত হন, তখন তিনি মক্কায় আস্তে আস্তে ইসলাম প্রচার শুরু করেন। যখন তার দাওয়াত ধীরে ধীরে বিশাল আকার ধারণ করতে লাগল, যখন চারদিক থেকে নির্যাতিত, নিষ্পেষিত মানুষেরা তার কাফেলায় এসে শামিল হতে লাগল, ব্যাপারটি তখন আরবের গোত্রপ্রধানদের নজরে এলো। তারা ভাবল, না, এই লোককে তো দমন করতে হবে। তারা ইসলামধর্মে ধর্মান্তরিত হয়ে আসা মানুষগুলোর ওপরে চালাতে লাগল অমানুষিক অত্যাচার, নির্যাতন। নির্যাতনের সেই মাত্রা এতটাই ভয়াবহ এবং পৈশাচিক ছিল; যা বর্ণনাতীত। বুকের ওপর পাথর তুলে দেওয়া, তপ্ত মরুভূমিতে বেঁধে রাখাসহ নানাবিধ অত্যাচার। তবুও দমে যাননি মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং তার সঙ্গীরা। এরকম অমানুষিক নির্যাতনের মুখেও মানুষ দলে দলে ইসলামধর্মে যোগ দিতে শুরু করল। কুরাইশদের পরিকল্পনা কোনো কাজে আসলো। তারা ভাবল, না, এভাবে তো এদের দমানো যাবে না। তাহলে কী করা যায়?

এবার নতুন প্রস্তাব পাস হলো। কুরাইশ গোত্রপ্রধান, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে এসে বলল, মুহাম্মাদ, তুমি কী চাও বলো? তুমি যদি চাও তাহলে তোমাকে আমরা আমাদের রাজা বানিয়ে নেব। আরব মুলুকের শ্রেষ্ঠ সুন্দরী নারীদের এনে তোমার পায়ের কাছে রেখে যাব। তবুও তুমি নতুন যে-ধর্মের কথা মানুষকে বলে বেড়াচ্ছ, সেটি বন্ধ করে দাও।

চিন্তা করুন, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে কীসের লোভ দেখানো হলো? রাজা হওয়ার এবং আরবকুলের শ্রেষ্ঠ সুন্দরী নারীদের ভোগ করতে পারার লোভ; কিন্তু মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কী বলেছিলেন সেদিন, জানেন?

কী?

তিনি তাদের প্রস্তাব হেসে উড়িয়ে দিয়ে বলেছিলেন, আমার একহাতে যদি সূর্য আর অন্য হাতে চাঁদও এনে দাও, তবুও আমি এই সত্যপ্রচার থেকে একটুও পিছপা হবো না। কী আশ্চর্য! যে-লোককে আজ নাস্তিকরা নারীলোভী বলতে চাচ্ছে, সেই লোকের সামনে যখন আরবের শ্রেষ্ঠ সুন্দরী নারীদের হস্তগত করার সুযোগ এলো, তিনি সেই প্রস্তাব হেসেই উড়িয়ে দিলেন। বলুন তো বড়দা, এরকম নারীলোভী আপনি কখনো দেখেছেন জীবনে?

খেয়াল করলাম, দীনেশ আচার্য নামের লোকটি ঢোক গিলল দু-বার। টেবিলে থাকা জগ থেকে পানি ঢেলে নিয়ে ঢকঢক করে পান করে সাজিদ আবার বলতে শুরু করল—মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জীবনে যে-কয়টি বিবাহ করেছেন তাদের সবাই ছিলেন বয়স্কা এবং বিধবা; কেবল আয়িশা রাযিয়াল্লাহু আনহা ব্যতীত। অথচ একটি হাদীসে পাওয়া যায়, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একবার জাবির ইবনু আব্দিল্লাহকে জিজ্ঞেস করলেন, তিনি কুমারী কোনো নারীকে বিয়ে করেছেন কি না। জাবির রাযিয়াল্লাহু আনহু যখন বললেন, তিনি একজন বিধবাকেই বিয়ে করেছেন, তখন আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, কুমারী মেয়েকে বিয়ে করলে না কেন? তাহলে তোমরা দুজনে মিলে আনন্দ করতে পারতে।

মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জানতেন যে, কুমারী নারী বিয়ে করলে শারীরিক তৃপ্তি বেশি পাওয়া যায়। তাই তিনি জাবির রাযিয়াল্লাহু আনহুকে কুমারী কেন বিয়ে করল না সে-ব্যাপারে প্রশ্ন করলেন। অথচ তিনি নিজে যাদের বিয়ে করেছেন তাদের সবাই ছিলেন বয়স্কা এবং বিধবা। যদি তিনি নারীলোভীই হতেন, তাহলে তো তিনি বেছে বেছে কুমারী মেয়েদেরই বিয়ে করতেন, তাই না?

এক্সাক্টলি, আমি বললাম।

সাজিদ বলতে লাগল, এই আলোচনা থেকে আমরা জানতে পারি যে, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কখনোই নারীলোভী ছিলেন না। এটি স্রেফ তার নামে অপবাদ।

রমেশ আচার্য বলে উঠলেন, মাই ডিয়ার সাজিদ, আমি এখনো এই বিষয়টাই বুঝতে পারলাম না, কেন তার এতগুলো স্ত্রীর দরকার ছিল?

লোকটার কথা শুনে আমার মাথা তৃতীয় বারের মতো গরম হয়ে গেল। সাজিদ কিছু বলার আগে আমি বলে উঠলাম, মি. আচার্য, আমি কিছু বলতে চাই। লোকটি আমার দিকে দৃষ্টি দিয়ে বললেন, শিওর।

আপনি কি নিজেকে একজন নাস্তিক দাবি করেন?

অবশ্যই করি।

আপনি কি ব্যক্তিস্বাধীনতায় বিশ্বাসী?

অবশ্যই।

আপনি যখন ব্যক্তিস্বাধীনতায় বিশ্বাস করেন, তাহলে আরেকজন লোক কেন এতগুলো বিয়ে করল সেটি তো আপনার মাথাব্যথার কারণ হতে পারে না, তাই না? কে কতগুলো বিয়ে করল সে ব্যাপারে তো আপনার নাক গলানোর কিছু নেই।

তুমি খুব বেশিই রেগে যাচ্ছ মাই ডিয়ার, লোকটি বললেন।

সাজিদ আমার দিকে তাকিয়ে চোখের ইশারায় আমাকে ধৈর্য ধরতে এবং চুপ করতে বলল। লোকটিকে আরও কিছু বলতে যাচ্ছিলাম; কিন্তু সাজিদের অনুরোধে নিজের ক্ষোভ নিজের ভেতরেই চাপা দিলাম।

সাজিদ বলতে লাগল, আচ্ছা, আমার একটি প্রশ্ন আছে। বহুবিবাহ ব্যাপারটি যদি কোনো সমাজে পারমিটেড কিছু হয়, তাহলে সেটি অনুসরণ করতে কোনো অসুবিধে আছে কি?

না, বললেন সাজিদের বড়দা ওরফে দীনেশ আচার্য।

ঠিক আছে। আমরা যদি তৎকালীন আরবের দিকে তাকাই, আমরা দেখতে পাব, জাহিলিয়াতের ওই সময়টায় নারীদের না ছিল কোনো মর্যাদা, না ছিল কোনো অধিকার। সে-সময়ে জীবন্ত কন্যাশিশুদের কবরস্থ করা হতো। পুরুষকুল নারীদের রক্ষিতা হিশেবে ব্যবহার করত। ঠিক এমনই একটি সময়ে এসে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নারীদের মর্যাদা সমুন্নত করে দিলেন। তিনি নিজে নারীদের স্ত্রীর মর্যাদা দিয়ে দেখিয়ে দিলেন—নারীরা রক্ষিতা হবার জিনিস নয়।

রমেশ আচার্য বলে উঠলেন, বাট, চৌদ্দশো বছর আগে আরবের কালচারে কী ছিল আর কী হতো তা দিয়ে তো তুমি মুহাম্মাদের বহুবিবাহকে জাস্টিফাই করতে পারো না সাজিদ।

কোনটি চৌদ্দশো বছর আগের কালচার?, সাজিদ জানতে চায়।

এই যে, আরবে তখন নারীদের রক্ষিতা হিশেবে রাখার ব্যাপারটি।

এটি তো শুধু আরবের কালচার ছিল না, এটি পুরো বিশ্বেরই একটি চিত্র। শুধু কি চৌদ্দশো বছর আগের ঘটনা এসব? এগুলো তো আমাদের সমাজে সেদিন পর্যন্ত প্রচলিত ছিল।

বুঝলাম না কথাটা। নড়েচড়ে বসলেন দীনেশ আচার্য। সাজিদ বলতে লাগল, বুঝিয়ে বলছি। ১৯৩৮ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পাওয়া আমেরিকান লেখিকা Pearl S. Buck এর নাম শুনেছেন?

রমেশ আচার্য বললেন, হ্যাঁ। শুনেছি।

তার অধিকাংশ উপন্যাস চীনের সামাজিক পটভূমির ওপরেই রচিত। তিনি তার fasno terasa A House Divided, East Wind : West Wind, The Good Earth ইত্যাদিতে ১৯০০ সালের দিকে চীনের সামাজিক প্রেক্ষাপটের ব্যাপারে সবিস্তারে বর্ণনা করেছেন। উপন্যাসসমূহে তিনি দেখিয়েছেন ওই সময়গুলোতে চীনের পুরুষেরা স্ত্রীর পাশাপাশি কীভাবে একাধিক রক্ষিতা রাখত। ওই রক্ষিতাদের গর্ভে চীনের প্রভাবশালী ব্যবসায়ী, ক্ষমতাবান রাজনীতিবিদদের জন্ম হয়, যারা কোনোদিন পিতার পরিচয় পাননি। শুধু তা-ই নয়, আমাদের ভারতীয় উপমহাদেশের নিকট-অতীতের ইতিহাসের দিকে তাকালেও আপনি একই রকম চিত্র দেখতে পাবেন।

তাই নাকি? জানতে চাইল রমেশ আচার্য।

জি। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের নাম শুনেছেন? পশ্চিমবঙ্গের কথাসাহিত্যিক?

হ্যাঁ।

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের বিখ্যাত একটি উপন্যাসের নাম হচ্ছে প্রথম আলো। ভারতীয় উপমহাদেশের অনেক রথী-মহারথী ব্যক্তিত্বের জীবনী তিনি সেখানে চমৎকারভাবে বর্ণনা করেছেন। ব্রিটিশ ভারতের সময়কালে, অর্থাৎ ১৯০০ সালের দিকে ত্রিপুরার মহারাজ চন্দ্র মাণিক্যের যে অনেকগুলো রক্ষিতা ছিল, সেই কাহিনি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় খুব সুন্দরভাবেই তুলে ধরেছেন উপন্যাসটিতে। চন্দ্র মাণিক্যের ওই রক্ষিতাদের গর্ভে তার অনেক সন্তান জন্মলাভ করে, যাদের চন্দ্র মাণিক্যের পৌরুষের প্রতীক বলা হতো।

আই সী, অবাক হলেন দীনেশ আচার্য।

এই হচ্ছে আমাদের সমাজের খুব নিকট-অতীতের কথা। আর, রমেশ দা বলছেন আমি কেন চৌদ্দশো বছর আগের কালচার টেনে একাধিক বিয়েকে জাস্টিফাই করছি।

রমেশ আচার্য কাচুমাচু মুখ নিয়ে বললেন, সরি টু সে সাজিদ। এসব আসলে আমার জানা ছিল না।

ফাইন। আমি আপনাকে বিব্রত করার জন্যে এসব ইতিহাস টেনে আনিনি। আমি শুধু এটি দেখাতে চেয়েছিলাম যে, এই কালচারটি কত আগেই মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সংস্কার করে গিয়েছেন। নারীদের তিনি দিয়ে গেছেন তাদের প্রাপ্য মর্যাদা। পরিপূর্ণ অধিকার…।

দীনেশ আচার্য বললেন, আমার মনে হয় কী জানো? মুহাম্মাদের এগারোটি বিয়ের পেছনে কোনো যৌক্তিক কারণ থাকতে পারে। তোমার কী মনে হয় সাজিদ?

অবশ্যই, সাজিদ বলল। আপনি যদি মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবনের সব ঘটনা পরম্পরায় সাজান, আপনি অবাক বিস্ময়ে খেয়াল করবেন যে, সেগুলোর পেছনে যৌক্তিক কোনো-না-কোনো কারণ অবশ্যই রয়েছে। আর বিয়ে হলো একজন মানুষের জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বেলাতেও সেটি প্রযোজ্য। এরকম গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলোর পেছনে কোনো লজিক থাকবে না, তা কীভাবে হয়?

কী সেই কারণগুলো?, জানতে চাইল রমেশ আচার্য।

সাজিদ বলতে লাগল, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন নবুওয়াত প্রাপ্ত হয়ে দ্বীনের দাওয়াত দেওয়া শুরু করলেন, তখন তিনি হয়ে উঠলেন মুসলমানদের একচ্ছত্র নেতা, একচ্ছত্র সেনাপতি। তার কিছু বিয়ে ছিল সন্তানদের দেখভালের দায়িত্ব অর্পণের জন্য। যেমন সাওদা রাযিয়াল্লাহু আনহা। খাদিজা রাযিয়াল্লাহু আনহা মারা যাওয়ার পরে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের চার কন্যাসন্তানকে দেখভালের তাগিদেই তিনি তাকে বিয়ে করেন। তার কিছু বিয়ে ছিল অন্য গোত্রের সাথে জোরদার সম্পর্ক তৈরির খাতিরে। যেমন বনু মুসতালিক গোত্রের নেতা হারেসার কন্যা জুরাইরিয়া রাযিয়াল্লাহু আনহার কথাই ধরুন। পিতা হারেসার সাথে বন্দি হয়ে আসার পরে তিনি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে মুক্তি চাইলে তিনি তাকে মুক্তি দেন এবং বিবাহেরও প্রস্তাব দেন। এতে তিনি রাজি হন এবং তাদের বিয়ে সম্পন্ন হয়। বিয়ের পরে হারেসা নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের শ্বশুর হয়ে গেলেন। এদিকটি বিবেচনা করে সাহাবীরা বনু মুসতালিক গোত্রের সবাইকে মুক্ত করে দেয়। এতে বনু মুসতালিক গোত্রের সকলে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং তার সঙ্গীদের আচার, আচরণ ও মহত্ত্ব দেখে ইসলাম গ্রহণ করে। ঠিক একই রকম ব্যাপার সাফিয়া রাযিয়াল্লাহু আনহার বেলাতেও। এভাবে ইসলামের চরম শত্র গোত্রগুলো পরিণত হলো ইসলামের পরম মিত্র গোত্রে। বলুন তো বড়দা, একজন পলিটিশিয়ান হিশেবে, একজন রাষ্ট্রনায়ক হিশেবে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এই কৌশলকে আপনি কীভাবে দেখবেন?

ইট ওয়াজ ডেফিনেটলি অ্যা গুড ডিসিশান। বড়দা বললেন। এরপর নিজের খুব কাছের সাহাবীদের সাথে সম্পর্ক আরও মজবুত, আরও শক্তিশালী করার জন্যে তিনি তাদের সাথেও সম্পর্ক পেতেছেন। তিনি বিয়ে করেছেন উমার রাযিয়াল্লাহু আনহুর কন্যা হাফসা রাযিয়াল্লাহু আনহা এবং আবু বকর রাযিয়াল্লাহু আনহুর কন্যা আয়িশা রাযিয়াল্লাহু আনহাকে। শুধু তা-ই নয়, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজের কন্যা ফাতিমা রাযিয়াল্লাহু আনহাকে আলী রাযিয়াল্লাহু আনহুর সাথে এবং কুলসুম আর রুকাইয়াহকে বিয়ে দিয়েছেন উসমান রাযিয়াল্লাহু আনহুর সাথে। আপনি ইসলামের ইতিহাস দেখুন, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মৃত্যুর পর কিন্তু এই চারজনই ধারাবাহিকভাবে খলীফা তথা মুসলমানদের আমীর নির্বাচিত হয়। এবার বুঝতে পেরেছেন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কৌশলটি কত বিস্তৃত ছিল?

বড়দা এবং রমেশ আচার্য, দুজনেই চুপ করে আছে। সাজিদ বলতে লাগল, যাইনাব বিনতে জাহাশ, যিনি ছিলেন মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ফুফাত বোন, তার সাথেও বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন তিনি। কেন জানেন?

রমেশ আচার্য জানতে চাইল, কেন?

কারণ, আরবের প্রচলিত নিয়ম ছিল, পালকপুত্র হলো নিজের পুত্রের মতো। তাই পালকপুত্রের স্ত্রীকে পরে কেউ বিয়ে করতে পারত না, নিষিদ্ধ ছিল। ইসলাম এসে এই সংস্কৃতির মূলোৎপাটন করে। রাসূল তার পালকপুত্র যায়েদের কাছ থেকে তালাক পাওয়া যাইনাব বিনতে জাহাশকে বিয়ে করে আরবদের জৈবনিক প্রমাণ দিয়ে দেখালেন যে, পালকপুত্র কখনোই নিজের পুত্র হতে পারে না। তাদের তালাক দেওয়া, তাদের সাথে সম্পর্কচ্ছেদ হওয়া নারীদেরও বিয়ে করা যায়। এটাই হলো যাইনাব বিনতে জাহাশ রাযিয়াল্লাহু আনহাকে বিয়ে করার পেছনে অন্যতম মাহাত্ম্য।

বড়দা বললেন, বুঝতে পারলাম।

এগুলো হলো রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বহু বিবাহের কিছু কারণ। এসব ছাড়া আরও কারণ আছে। যেমন—পুরুষদের জন্য যে-সব মাসআলা-মাসায়েল, সেগুলো তারা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছ থেকে সরাসরি জেনে নিতেন বা শুনে নিতে পারতেন; কিন্তু নারীদের ব্যাপারে সে সুযোগ ছিল না। কারণ, পর্দার বিধান লঙ্ঘন করে তিনি নারীদের সামনে গিয়ে মাসআলা-মাসায়েল নিয়ে আলাপ করতে পারেন না। তাহলে নারীরা কীভাবে রাসূলের কাছ থেকে শিখবে? জ্ঞানার্জন করবে? তাদের জন্য এই কাজটি সহজ হয়ে যায় উম্মুল মুমিনীন তথা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের স্ত্রীদের মাধ্যমে। তিনি স্ত্রীদের সাথে যে-সব মাসআলা-মাসায়েল নিয়ে আলাপ করতেন, তার স্ত্রীগণ সেগুলো অন্য নারীদের জানিয়ে দিতেন। এভাবেই দ্বীনের জ্ঞান নারীদের মধ্যেও সমানভাবে ছড়িয়ে পড়ে; কিন্তু একজন স্ত্রীর পক্ষে একা কখনোই এই দায়িত্ব পালন করা সহজ ছিল না। এ ছাড়াও, বহু স্ত্রীর মধ্যে কীভাবে সমতা রক্ষা করতে হবে এই শিক্ষা উম্মাহকে দিয়ে যাওয়াও অন্যতম একটি কারণ।

সাজিদ কথা বলা থামিয়ে আরেক গ্লাস পানি পান করল। রমেশ আচার্য নামের লোকটি কিছুই বলছে না। বড়দা ওরফে দীনেশ আচার্য বললেন, রমেশ দা কিছু বলবে?

তিনি অস্ফুট স্বরে বললেন, না।

আমাদের হাতের সময় ফুরিয়েছে। চলে আসার জন্য আমরা উঠে দাঁড়ালাম। দুই আচার্যের সাথে হ্যান্ডশেক করে আমরা হাঁটতে শুরু করলাম। বড়দা আমাদের দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিলেন। বাইরে আসামাত্র সাজিদ বলল, তুই যে-সাদা ফুলগুলোর দিকে অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে ছিলি, সেই ফুলগুলোর নাম জানিস?

সাজিদের কথা শুনে আমি হাঁ করে তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। আমার অবাক হবার কারণ হলো, আমি যখন ফুলগুলো দেখছিলাম তখন সে আমার কাছ থেকে অনেক দূরে ছিল। সে কীভাবে বুঝল যে আমি তখন সাদা রঙের ফুলগুলো দেখছিলাম?

আমি যে-বিস্ময় নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছি সেদিকে তার কোনো ভুক্ষেপ নেই। সে বলল, ওই ফুলগুলোর নাম হলো মধুমঞ্জরি। ইংরেজরা ওই ফুলগুলোকে ডাকে রেংগুনকিপার নামে। আর আসার সময় প্রকাণ্ড সাইজের মাথাওয়ালা যে-লোকটির সাথে ঝগড়া করেছিস, সে ওগুলোকে উইকেটকিপার নামে ডাকে। বড়দা তাকে কত করে শেখায় এই ফুলগুলোর নাম রেংগুনকিপার, বেচারা তবুও ভুল করে ডাকে উইকেটকিপার বলে। হা হা হা…। সাজিদের হাসি দেখে আমারও হাসি পায়। ফুলের নাম উইকেটকিপার! দারুণ তো!…

No comments

Powered by Blogger.